ভবকে কারাগার বলা হয় কেন।
ভবকে কারাগার বলার কারণ দেশনায় ভদন্ত পঞ্ঞাদীপ ভিক্খু মহোদয়।
বুদ্ধ ভবকে কারাগার বলেছেন। আমরা সবাই ভব কারাগারে বন্দি। কথাটি আসলেই ঠিক, তৃষ্ণা যেখানে রাখে, যেটিকে করতে বলে তার আদেশ পালনের বাধ্য কর্মচারী কারাবন্দি দাস।
লোভ-দ্বেষ-মোহ ক্লেশ কলুষের অধীনে পরাধীন বন্দীশালাতে কারাভোগী। বুদ্ধ বলেছেন-"তণ্হাদাসো" সকল সত্ত্ব তৃষ্ণার দাস। "তৃষ্ণার ইচ্ছা পূরণ না করে কোথাও যাবার পথ নেই" সে যা করতে বলে তা করে দিতে হয়।
সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দক্ষিণের মানুষ উত্তরে যায়। উত্তরের মানুষ দক্ষিণে যায়। পূর্বদিকের মানুষ পশ্চিমে যায়। পশ্চিমের মানুষ গুলো পূর্বদিকে যায়। গাড়ি পথ, বায়ুপথ, রেলপথ, নৌ-পথ, পায়ে হেঁটে যায় জীবিকার কর্মস্থলে, কঠোর পরিশ্রম করে ফিরে আসে।
কার আদেশ নির্দেশে অত অক্লান্ত পরিশ্রম করে থাকে?
তৃষ্ণার আদেশে করে থাকে। মানুষের মনের স্বভাব বস্তুতঃ সাদা। পুণ্যর প্রভাবে মানবকুলে জন্ম হওয়া মানুষের মন প্রকৃতিগতই ভালো। তবে ক্লেশ কলুষের অধীনস্থ থাকতে বাধ্য হবার কারনে মানুষের আসল মনের স্বভাব লুপ্ত হয়ে মনুষত্বকে হারিয়ে অমনুষ্য অসূর হয়ে যায়।
বাস্তবে মনুষ্যত্বের মন সৎকর্ম করে। মানুষের মন সবসময় একই রকম থাকে না, মুহুর্তে মুহুর্তে বদল হয়। কলুষ মুক্ত সময়ে সাদা মনের মানুষ হয়, কলুষযুক্ত হলে অমানুষ অসূর চরিত্রে পরিণত হয়। যখন মানুষের মন হয় তখন সৎকর্ম করে আর যখন অমনুষ মন হয় তখন আকাম-কুকাজ নিন্দনীয় কাজ করে।
আসলে ঠিক এটি একটি দাসত্তের জীবন। অধীনস্থের জীবন। নিজের মত করে থাকা যায় না। নিজের মত করে শোয়া যায় না। নিজের মত করে খেতে পারে না। নিজের মত করে করা যায় না। সবক্ষেত্রে মালিকের কথা মতে চলতে হয়।
বুদ্ধ মুখনিঃসৃত বচন হল- নিকায় বা ত্রিপিট বা ধর্মবিনয় বা ধর্মস্কন্ধ সবিই বিমুক্তিরস। অরহত হয়ে গেলে "অনুপাদায আসবেহি চিত্তনি বিমুচ্চিসু"- উপাদান (দৃষ্টি আস্রব) মুক্ত বা চিত্তবীথি থেকে আস্রব মুক্ত হলে ভবের কারাগার থেকে মুক্ত। অরহত মানেই হল ভব কারাগার থেকে মুক্ত।
ভব কারাগার থেকে মুক্ত হতে হলে আস্রব থেকে মুক্ত হতে হয়। আস্রব বা ক্লেশ হল লোভ-দ্বেষ-মোহাদিকে বলে। ক্লেশের কারণে দৃষ্টি আস্রব হয়।
প্রতিত্যসমুৎপাদেও "তণ্হা পচ্চযো উপাদান" তৃষ্ণার কারণে দৃষ্টি আস্রব হয়। তৃষ্ণার কারণে উপাদান (দৃঢ় আসক্তি) হয়। আর তৃষ্ণা বেদনার কারণে হয়। বেদনা স্পর্শের কারণে হয়।
চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, কায় ও মন এ ০৬টি দ্বারে রূপ, শব্দ, গন্ধ, রস, স্পর্শ ও ধর্ম এ ৬টি বিষয় (আলম্বন) অবলম্বনে বেদনা হয়। দেদনার কারণে তৃষ্ণা হয়। "দুক্খ সুখং বত্থযতি"- দুঃখ অনুভব হলে সুখের আশা করে। দুঃখের কারণে তৃষ্ণা হয়।
"সুখী ভিযোপি ইচ্ছতি"- সুখি হলে ততোধিক সুখ আশা করে। সুখের কারণেও তৃষ্ণা হয়। "বেদনা নিরোধা তণ্হা নিরোধো"- বেদনা নিরোধে তৃষ্ণা নিরোধ হয়। তৃষ্ণা নিরোধে উপাদান নিরোধ হয়। উপাদান নিরোধে ক্লেশ অধীনস্থ থেকে মুক্ত হয়। ক্লেশ ও ভব কারাগার থেকে চিরমুক্ত হবার জন্য বেদনাকে নিরোধ পর্যন্ত বিদর্শন করতে হয়। বেদনাকে নিরোধ করতে হলে বিষয় আলম্বন অবলম্বনকে অনুভব না করা বা বিমুখ হওয়া।
চতুর্প্রত্যয় ব্যবহার করে হয় কর্মস্থান অনুশীলনের জন্য। বিষয় রসকে আস্বাদ করার জন্য নয়। তাই বুদ্ধ বলেছেন- "দিট্ঠে দিট্ঠমত্ত"- দেখলে দেখামাত্র। সুতে সুতমত্ত- শনলে শুনামাত্র। মুতে মুতমত্ত- গন্ধমাত্র, রস্বাদমাত্র। স্পর্শমাত্র, ভাবলে ভাবামাত্র দর্শন করা, তারচেয়ে সামনে এগিয়ে অনুভব না করা।
বিষয়ের ব্যবহার ক্ষণে সেটিকে অনুভব না করে উদয়ব্যয় দর্শন করতে পারলে বেদনা নিরোধে তৃষ্ণা নিরোধ, উপাদান নিরোধ, ক্লেশোপশম হয়ে ভব কারাগার থেকে মুক্ত হতে পারে। সবার হিত সুখ মঙ্গল হোক।
#সাধু-সাধু-সাধু।
লেখক-
স্বধর্ম দেশক, বিদর্শন আচার্য
ভদন্ত পঞ্ঞাদীপ থের মহোদয়।
রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা।তারিখ-২৯ জুলাই ২০২১ খ্রিঃ।
Comments
Post a Comment