ভিডিও গেম আসক্তি মানসিক রোগের পর্যায় WHO।
ভিডিও গেম আসক্তি। ভিডিও গেমের প্রতি শিশু-কিশোরদের আসক্তিকে 'মানসিক রোগের' তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
ভিডিও গেম আসক্তি মানসিক রোগের পর্যায় World Health Organization (WHO)।
খেলাধুলা প্রতিটি শিশু-কিশোরের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ সাধন করে। খেলাধুলা করার ফলে শিশু-কিশোরদের মধ্যে সৃজনশীল চিন্তা শক্তির বিকাশ হয় এবং প্রতিটি শিশু-কিশোরের মধ্যে নেতৃত্ব দেওয়ার এবং ঐক্যবদ্ধ হওয়ার শক্তি জাগ্রত হয়। খেলাধুলার জয়-পরাজয়ের মত মানব জীবনেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে জয়-পরাজয়ে মনোবল সুদৃঢ় রাখার এবং জয় পরাজয় মেনে নেওয়ার যোগ্যতা অর্জিত হয়।
আজ থেকে অনুমান ১০/১৫ বছর পূর্বেও বাংলাদেশের বেশিরভাগ শিশু, কিশোর-কিশোরীরা কুত-কুত, কানামাছি ভোঁ-ভোঁ, মোরগ লড়াই, ওপেন টি বাইস্কোপ, সাতচাড়া, এক্কা-দোক্কা, ডাঙ্গুলি খেলা, হাডুডু খেলা, গুলতি ছোড়া, বস্তা দৌড়, মার্বেল খেলা, কড়ি খেলা, বিস্কুট দৌঁড়, গুটি খেলা, গোল্লাছুট, বৌছি, ইচিং বিচিং, হাড়ি ভাঙ্গা, দড়িলাফ, ঘুড়ি ওড়ানো, দড়ি টানাটানি, বালিশ বদল, লাটিম খেলা, ফুটবল, ক্রিকেট সহ বিভিন্ন রকম দেশীয় খেলাধুলা করত। যা আউটডোর গেইম নামে পরিচিত।
এছাড়াও, পাঞ্জা লড়াই, লুডু খেলা, ক্যারাম বোর্ড সহ বিভিন্ন খেলাধুলা করে শিশু ও কিশোর মনের প্রফুল্লতা আনায়ন করত। যা ইনডোর খেলাধুলা হিসাবে পরিচিত।
এসব খেলাধুলা বর্তমানেও প্রচলিত আছে। কিন্তু তুলনামূলকভাবে অনেকটা কম।
সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে ঘরে ঘরে এন্ড্রয়েড মোবাইল, ট্যাব, কম্পিউটার ও ল্যাপটপের সহজলভ্যতার ফলে এসব দেশীয় খেলাধুলা এখন পরিবর্তন হয়ে একটি ছোট্ট ডিসপ্লেতে অনেক ছেলে-মেয়ে অফলাইনে বিভিন্ন ভিডিও গেইমে আসক্ত হয়ে পড়েছে।
বেশ কয়েক বছর যাবৎ অনেকের মধ্যে অনলাইন ভিডিও গেইমের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
গত ২/৩ বছর পূর্বে উঠতি বয়সীদের মধ্যে ব্লহোয়েল চ্যালেঞ্জ নামীয় গেইমের ফলে বিভিন্নরকম বিরূপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ্যণীয় ছিল। কয়েক বছর ধরে নতুন করে উঠতি বয়সীদের মধ্যে আবার শুরু হয়েছে পাবজি, ফ্রিফায়ার সহ বিভিন্ন অনলাইন ভিডিও গেইম খেলার আসক্তি।
অনেকে নিজ নিজ বাড়ীতে এসব ভিডিও গেইম খেলছে। পাশাপাশি গাড়ীতে, রেস্টুরেন্টে কিংবা পার্কে বসে এসব ভিডিও গেইম খেলছে। ভিডিও গেইম খেলার সময় কানে হেডফোন লাগিয়ে চিৎকার চেঁচামেচির ফলে কোন পাবলিক প্লেসে এখন শান্তি নেই।
অনেক সময় গাড়ীতে কোথাও যাওয়ার সময় দেখা যায়, কয়েকজন কানে হেডফোন লাগিয়ে এসব ভিডিও গেইম খেলছে এবং এইদিকে মার, ঐদিকে মার, ডানে মার, উপরে এ্যানিমি, ডানে দেখ, পিছনে আসছে, এ্যানিমিকে মার, মার-মার ইত্যাদি বিরক্তি হৈচৈ, চিৎকার চেঁচামেচিতে রত আছে।
যারা এসবের বাহিরে আছে তাদেরকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও এসব বিরক্তি সহ্য করতে হচ্ছে।
অনেকে বলে ভিডিও গেইম খেলছি, আমিতো অন্যায় কিছু করছি না, খারাপ সঙ্গ থেকে দূরে আছি ইত্যাদি ইত্যাদি যুক্তির শেষ নেই ।যারা কিছু সময় টাইম পাস করার জন্য এসব ভিডিও গেইমে খেলে তাদের জন্য সমস্যা নেই।
মূল কথা হলো প্রতিটি জিনিসের একটি নির্দিষ্ট মাত্রা ও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অতিরিক্ত কোন কিছুই ভাল নয়।
মাদক যদি নেশা হয় ভিডিও গেইম মাদকের চাইতে কম নয়। যারা ভিডিও গেইমে অতিমাত্রায় আসক্ত তাদের কথাবার্তা, ঘুম, চাল-চলন, খাওয়া-দাওয়া, কাজকর্ম সহ বিভিন্ন বিষয়ে বিরূপ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
ভিডিও গেইমে জড়ানোর অনেক কারণের মধ্যে নিম্ন বর্ণিত কিছু কারণ লক্ষ্যণীয় বলে আমার মনে হয়ঃ
- প্রথমত খেলার মাঠের স্বল্পতা।
- পারিবারিক চিত্ত বিনোদনের অভাব।
- একক পরিবার।
- পারিবারিক কলহ।
- একাকিত্ব।
- বেকারত্ব।
- অনেক বন্ধুমহলে নিরাপত্তাহীনতা।
- হাতে হাতে সহজলভ্য ডিভাইস বা এন্ড্রয়েড মোবাইল ফোন।
- অতি মাত্রায় এন্ড্রয়েড সংস্কৃতি।
- অতিমাত্রায় ইন্টারনেট নির্ভরতা।
- ডিভাইসে টোক করে আওয়াজ দেওয়ার সাথে সাথে নোটিফিকেশন চেকের মানসিকতা ইত্যাদি।
অন্যদিকে অনেক অভিভাবক নিজের সন্তানের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে এসব ডিভাইসের প্রতি আসক্তিকে ভাল মনে করে থাকেন। যদিও অনেকের ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার পর ভুল বুঝতে পারেন। অনেকে আবার বন্ধুবান্ধব বা অন্যের দেখাদেখি এসবের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে।
ভিডিও গেইমে আসক্তির কারণে যেসব সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে ঃ
- লেখাপড়ায় অমনযোগী হয়ে পড়া।
- অভিভাবকের কথা না শোনা।
- দৈনন্দিন কাজে অমনোযোগী হয়ে পড়া।
- রাতে ঘুম না হওয়ায় দেরিতে কর্মস্থলে হাজির এবং কাজের ভিত বা চাকুরী ভিত নরবরে হয়ে যাওয়া।
- কথাবার্তায় ও চালচলনে উগ্রতার ভাব এবং নমনীয়তা ও সৃজনশীলতার অভাব।
- ঘুম কম হওয়ায় ঘুমঘুম ভাব।
- খাওয়া-দাওয়ায় মন না থাকা।
- বেকারত্ব সৃষ্টি।
- সৃজনশীল নাগরিক তৈরীতে বাঁধা।
- ইন্টারনেট কেনার জন্য পরিবারের সাথে ঝগড়াঝাটি
- পারিবারিক ও সামাজিক অশান্তি ইত্যাদি কুপ্রভাব লক্ষ্যণীয়।
ছোট একটি ঘটনা বলি, আমি আজকে একটি মিষ্টির দোকানে নাস্তা করার সময় দেখলাম ১৭/১৮ বছরের এক দোকান কর্মচারীকে ম্যানেজার বকাবকি করছে। সে প্রতিনিয়ত দেরিতে কর্মস্থলে আসছে, কাজে অমনযোগী ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমি বিষয়টি দেখে নাস্তা শেষে ম্যানেজারকে জিজ্ঞাসা করলাম কি হয়েছে ?
তিনি বললেন ছেলেটি আগে ঠিক সময়ে দোকানে আসত এবং কাজেও বেশ মনযোগী ছিল। বেশ কিছুদিন যাবৎ সে এন্ড্রয়েড মোবাইলে ফ্রিফায়ার নামীয় ভিডিও গেইমে আসক্ত। গভীর রাত পর্যন্ত সে ভিডিও গেইম খেলে। দোকানে সময়মত আসে না, আসলেও কাজে অমনযোগী এবং ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে থাকে।
তাই তাকে বকাবকি করছে। ম্যানেজারের কথায় মনে হলো এভাবে আর কয়েকদিন চলতে থাকলে তাকে আর দোকানে রাখবে না।
করণীয় কি ? আমার মতে কিছু করণীয় তুলে ধরা হল ঃ
- প্রত্যেকের পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় করা।
- দেশীয় খেলাধুলা করার চর্চা করা।
- পরিবারের সকল সদস্যদের মধ্যে পারিবারিক আড্ডা, বিনোদনের ব্যবস্থা করা।
- অবসরে সৃজনশীল কাজে মনোনিবেশ করা।
- নিজ নিজ ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা।
- নিজ নিজ কাজে (পড়াশুনা/চাকরী/ব্যবসা) মনযোগীয় হওয়া।
- এন্ড্রয়েড ডিভাইসের অতিমাত্রিক ব্যবহার না করে নিজ নিজ পরিবারের সদস্যদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আচার-আচরণ করা।
- দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা।
- আশপাশের দর্শনীয় স্থানে ভ্রমণ করা এবং সম্ভব হলে ছুটির দিনে পারিবারিকভাবে দেশের দর্শণীয় স্থানে ভ্রমণে যাওয়া।
- দৈনিক হাঁটাহাঁটি করার অভ্যাস করা ও ব্যায়াম করা।
- পরিবারের কাজে মনোনিবেশ করা।
- সামাজিক কাজে যোগদান করা।
- মানব সেবায় রত থাকা।
সৃজনশীল, নৈতিক, দক্ষ, মেধাবী ভবিষ্যত প্রজন্ম তৈরীতে মাদক নেশার মত অনলাইন ভিডিও গেইম একটি বড় বাঁধা। এই বাঁধা অতিক্রম করতে হবে। নইলে পরিবারে দেখা দিবে অশান্তি। যার ফলে ভবিষ্যত সমাজে নানান সমস্যা ও অশান্তি পরিলক্ষিত হবে।
দেশীয় সৃজনশীল খেলাধুলার ফলে মানসিক বিকাশের পাশাপাশি দেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা জন্মে এবং দেশপ্রেমও জাগ্রত হয়। যারা সৃজনশীল খেলাধুলা করে তাদের মধ্যে নৈতিক ও সৎচরিত্রের গুণাবলী অর্জিত হয়।
আধুনিকতা ভাল কিন্তু অতি আধুনিকতায় জীবন ভাসানো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। খেলাধুলা মানসিক প্রশান্তির জন্য এবং জীবনকে সুন্দর করার জন্য। এসব ভিডিও গেইমের ফলে একটি ডিসপ্লেতে জীবনের ছন্দ খুঁজতে গিয়ে অনেকে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দই (প্রশান্তিই) নষ্ট করে ফেলে।
আধুনিক সৃজনশীল, নৈতিক, দক্ষ, মেধাবী ভবিষ্যত প্রজন্ম তৈরীতে প্রতিটি অভিভাকদের সচেতন থাকা অত্যন্ত জরুরী।
#পোস্টটি ভাল লাগলে শেয়ার করে অন্যকে দেখার সুযোগ করে দিন।
ধন্যবাদ।
Comments
Post a Comment