বৌদ্ধদের জন্য আষাঢ়ী পূর্ণিমা কেন তাৎপর্যপূর্ণ।

তাৎপর্যপূর্ণ আষাঢ়ী পূর্ণিমা, আলোচনায় ভদন্ত পঞ্ঞাদীপ থের মহোদয়।

তাৎপর্যপূর্ণ আষাঢ়ী পূর্ণিমা।


বৌদ্ধদের তাৎপর্যপূর্ণ আষাঢ়ী পূর্ণিমাঃ

এ আষাঢ়ের ঋতুতে চতুর্দিক চতুর্কোণ আকাশ মেঘে ঢাকা থাকে। এ ঋতু আসলী নক্ষত্রযুক্ত গ্রহকাল। বস্সন্ত (বর্ষার ঋতুর) চার মাসের প্রথম মাস হল আষাঢ়। পুরো আকাশ মেঘ গর্জনের বৃষ্টি বর্ষণের কাল।
আষাঢ়ের ভিক্ষুসংঘ অন্যত্র না গিয়ে ০৩ মাস ধরে বিহারে অবস্থান করা, কোত্থাও গিয়ে রাত যাপন না করা, বর্ষাবাস অধিষ্ঠানের প্রজ্ঞাপ্ত বিনয় থাকায় এ সময়ে বিহারে বহু ভিক্ষুসংঘ অবস্থান করে থাকেন।

এ আষাঢ়ী পূর্ণিমায় বোধিসত্ত্ব মায়াদেবীর জঠরে প্রতিসন্ধি গ্রহণ।

চার নিমিত্ত দর্শন করে মহাভিনিষ্ক্রমণ গৃহত্যাগ।

বুদ্ধত্ব জ্ঞান লাভের পর প্রথম ধর্মচক্র প্রবর্তন সুত্র দেশনা প্রদান।

যমক প্রতিহার্য ঋদ্ধি প্রদর্শন করার পর মাতা সন্তুষিত দেবপুত্রকে মাতৃঋণ পরিশোধের জন্য তাবতিংস স্বর্গের গমন করা তাৎপর্যপূর্ণ রয়েছে।

গবেষণামূলকঃ

১। প্রতিসন্ধি ৬৭ মহাসাল আষাঢ়ী পূর্ণিমা বৃহস্পতিবার।
২। গৃহত্যাগ ৯৭ মহাসাল আষাঢ়ী পূর্ণিমা সোমবার।
৩। নব লোকুত্তর ধর্মচক্র প্রবর্তন সুত্র দেশনা ১০৩ মহাসাল আষাঢ়ী পূর্ণিমা শনিবার।
৪। যমক ঋদ্ধি প্রদর্শন।
৫। মাতা সন্তুষিত দেবপুত্রকে অভিধর্ম দেশনা প্রদানের জন্য তাবতিংস স্বর্গের গমন।

আষাঢ়ী পূর্ণিমা ধর্মচক্র দিবসঃ

বোধিসত্ত্ব গৌতম ১০৩ মহাসালে বৈশাখী পূর্ণিমা বুধবারে বুদ্ধত্ব জ্ঞান লাভ করেন।
"সহম্পতি নামকেন মহাব্রহ্মেন যাচিতো,
চতুসচ্চং পকাসেন্তো লোকনাথো অদেসযি"
সহম্পতি মহাব্রহ্মা চতুর্রায্য সত্য প্রকাশের জন্য প্রার্থনা করলে- প্রথমে কার নিকট প্রকাশ করবেন আশয়ানুশয় জ্ঞান, ইন্দ্রিয় পরোপরিযত্তি জ্ঞানে আলারকালাম ঋষিকে দেখতে পেলেন, তিনি তো গত সপ্তাহ কালগত হয়েছে এবং রামপুত্র রুদ্রকে দেখতে পেলেন তিনিও তো গতকল্য কালগত হয়েছে জেনে অন্য উপকারী পঞ্চবর্গীয় শিষ্যদেরকে দেখে বারাণসীর পথে গমন করলেন।

বারাণসী চক্ষুদৃশ্য স্থানে পঞ্চবর্গীয়রা বুদ্ধকে দেখতে পেয়ে বলাবলি করলেন যে অল্পাহার কৃচ্ছ্রসাধন করে বুদ্ধত্ব জ্ঞান লাভ ব্যর্থ সাধনভ্রষ্ট অপরিমিত আহার ভক্ষণ করার সিদ্ধার্থ আসছে। সে কি বুদ্ধত্ব জ্ঞান লাভ করতে পারবে এরুপ মনে করে তারা উরুবেলাতে বোধিসত্ত্বকে ত্যাগ করে বারাণসীর ঋষিপত্তন মৃগদাবনে চলে আসছিলেন।

বুদ্ধ তাদের নিকট আসতে দেখে পঞ্চবর্গীয়রা এরুপ বলাবলি করলেন যে তারা বুদ্ধের কোন ব্রতকর্ম করবেন না। যতই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করুক না বুদ্ধ তাদের সন্নিকটে আসলে পরে সমস্ত প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হয়ে পঞ্চবর্গীয় শিষ্যরা আগুবাড়িয়ে নিলেন, বন্দনা করলেন, সুলভ আলাপ করলেন।

সেই মহেন্দ্র ক্ষণ ছিল সূর্যালো ডুবাডুবা এবং পূর্ণচন্দ্রের আলো উত্থিত ক্ষণ। এ শুভ লগ্ন ছিল সাধুসজ্জনের অতি প্রভাকর। মৃগদাবনের প্রকৃতির পরিবেশ ছিল প্রীতিময় শান্তিময় সুখময়। তখনই পঞ্চবর্গীয়ের সমক্ষে পদ্মাসনে বসে ভিক্ষুগণ সম্বোধন করে নবলোকুত্তর ধর্মচক্র ধর্মদেশনা প্রদান সূচনা করেছিলেন।

পঞ্চবর্গীয়রা শীলে পরিশুদ্ধ ছিলেন। তাছাড়া শ্রদ্ধা, ছন্দ, বীর্য পরিপূর্ণ ছিলেন বলে বুদ্ধের ভিক্ষুগণ সম্বোধন সাড়া পেয়ে তাদের অন্তরে প্রতিষ্ঠা হতে লাগল। তৎসময়ে বুদ্ধ তিনি বুদ্ধত্ব জ্ঞান লাভ করার কথা খোলে বললেন। ধর্ম দেশনা শ্রবন করার জন্যও আহ্বান করলেন। তবে একথা বিশ্বাস না করার কারণে ০৩ বার পর্যন্ত আহ্বান করলেন। বুদ্ধ সে অবিশ্বাসকে দূর করার জন্য তিনি বুদ্ধত্ব জ্ঞান লাভের কথা পুনঃ প্রকাশ করেছিলেন।

অতপর "ধর্মচক্ক পবত্তন সুত্ত"কে দেশনা করলেন। ধর্ম দেশনার শেষে কোণ্ডঞ্ঞ (কোণ্ডণ্য) মানবের মধ্যে সর্ব প্রথম স্রোতাপত্তি মার্গ-ফলে প্রতিষ্ঠিত হলেন। সেদিন ছিল আষাঢ়ী পূর্ণিমা।
তারপর পূর্ণিমার পরদিন গুলোতে একেক জন করে ভদ্দিয, বপ্প, মহানাম ও অস্সজিত প্রত্যেকে স্রোতাপত্তি মার্গ-ফলকে প্রতিষ্ঠিত হলেন। পঞ্চবর্গীয় ভিক্ষু সকলেই "এহি ভিক্ষু" উপসম্পদা লাভ করলেন। আষাঢ়ী পূর্ণিমার ৫ম দিনে বুদ্ধ "অনাত্মলক্খণসুত্ত"কে দেশনা করলে সেদিনে সকলেই অরহত্ব মার্গ-ফলে প্রতিষ্ঠিত হলেন।

সেই দিনটিকে অরহত্ব দিবস বলে বৌদ্ধদের কেউ কেউ বলে থাকেন। বৌদ্ধরা আষাঢ়ী পূর্ণিমাকে "ধর্মচক্ক পবত্তন সুত্ত" দিবস পালন করে থাকেন।

বর্ষাবাস অধিষ্ঠানের অনুজ্ঞাঃ

বুদ্ধ মগধ বেণুবন বিহারে অবস্থান করেছিলেন। তখনো বর্ষাবাস অধিষ্ঠানের জন্য ভিক্ষুসংঘকে বিনয় প্রজ্ঞাপ্ত করেননি তিনি। ভিক্ষুরা হেমন্ত, গ্রীষ্ম, বর্ষা ০৩ ঋতু ধরে দেশচারী করার কারনে সাধারণ গ্রামের মানুষেরা নিন্দা অপবাদ করে যে এই বুদ্ধপুত্ররা হেমন্ত, গ্রীষ্ম, বর্ষা ০৩ ঋতুগুলোতে কেন ভ্রমণ করে।

কায়িন্দ্রিয় (রূপ জীবনী) বিদ্যমান সবুজ তৃণগুলোর উপর হেঁটে ক্ষতি করে। ক্ষুদ্র প্রাণীদের অনিষ্ঠ করে। তীর্থিক পরিব্রাজকরা তো বর্ষাকালে এক জায়গায় অবস্থান করে। পক্ষীরাও বাসা বেঁধে বাসায় থাকে। ভিক্ষুদেরকে গ্রামের মানুষের এরুপ নিন্দা অপবাদের কথা শুনতে পেয়ে বুদ্ধকে জানিয়ে দিলে তখন থেকে বর্ষাবাস অধিষ্ঠানের জন্য বিনয় প্রজ্ঞাপ্ত করেছিলেন। [ মহাবর্গ ভাসাটীকা ]

ভিক্ষুদের কেমন আচরণ?

সেই সময় ভিক্ষুরা বর্ষার দিনে ফসলী ধান খেতের আলের উপর হয়ে অন্যত্রে আসাযাওয়া করতো এতে ধানগুলো নষ্ট হতো। গ্রামের লোকেরা বুদ্ধের নিকট নিন্দার অপবাদ অভিযোগ করলে বুদ্ধ ভিক্ষুদেরকে ত্রৈমাস বর্ষার কালে কোত্থাও না গিয়ে এক বিহারে অবস্থান করে কর্মস্থান ভাবনা অনুৃশীলন করার জন্য বিনয় প্রজ্ঞাপ্ত করেছিলেন।

বর্ষাবাসিক চীবর দানের ফলঃ

একক হোক সার্বজনীন হোক বর্ষাবাস কালে দায়ক-দায়িকাগণ ভিক্ষুসংঘের উদ্দেশ্যে বর্ষাবাসিক চীবর দান করে থাকেন। প্রদত্ত দানের সুফল কতক মহৎ হয় তা জ্ঞাত হয়ে দান করলে মহৎফলপ্রদ হয়। তাই ৭টি সুফল সম্পর্কিত জ্ঞান দান করলাম-
১। নির্বাণ প্রত্যক্ষের অবধি জন্ম জন্মান্তরে পোষাক পরিচ্ছদ অভাব হয় না।
২। নির্বাণ প্রত্যক্ষের অবধি জন্ম জন্মান্তরে সুবর্ণময় দেহ হয়।
৩। নির্বাণ প্রত্যক্ষের অবধি জন্ম জন্মান্তরে দেহ থেকে আকর্ষণীয় বর্ণ উৎপন্ন হয়।
৪। নির্বাণ প্রত্যক্ষের অবধি জন্ম জন্মান্তরে কোমল দেহ হয়।
৫। নির্বাণ প্রত্যক্ষের অবধি জন্ম জন্মান্তরে দেহরূপ সুন্দর্য্য নষ্টাকারী তিল, ফোড়া, ব্রণ, দাগ, ছাপ ইত্যাদি উঠে না।
৬। নির্বাণ প্রত্যক্ষের অবধি জন্ম জন্মান্তরে যুগের তৈরির ইচ্ছিত আধুনিক মূল্যবান পোষাক পরিচ্ছদ লাভ হয়।

৭। প্রদত্ত বর্ষাবাসিক এ চীবর দানের পুণ্যের প্রভাব অনাগতে উৎপন্ন বুদ্ধের সাক্ষাত হলে “এহি ভিক্ষু” আহ্বানের যোগ্যতা সম্পন্ন হয়, এহি ভিক্ষু আহ্বান করার সাথে সাথে মুণ্ডণমস্তক, ১৫০০ ক্লেশ ক্ষয়ী চীবর ধারী অরহত হওয়া সহ উক্ত ৭টি পুণ্যের ফল লাভ করেন। এ ০৭টি পুণ্যফলের ০৬টি হলো লোকিক পুণ্যের ফল আর ০১টি হল লোকুত্তর ফল লাভ করেন।

এ লোকিক লোকুত্তর প্রণিহিত হিত সুখকর পুণ্যফল লাভের দান হল ত্রৈমাস বর্ষাবাস কালীন সংঘের উদ্দেশ্যে বর্ষাবাসিক চীবর দানের মহৎ ফল। এ দান বর্ষাবাসের যে কোন সময়ে করা যায়। সবার জ্ঞান ভাণ্ডার পূর্ণ সহ হিত সুখ মঙ্গল হোক। 


তাৎপর্যপূর্ণ আষাঢ়ী পূর্ণিমাঃ

২৩শে জুলাই ২০২১ইং "আষাঢ়ী পূর্ণিমা" ধর্মচক্র দিবস।
১০৩ মহাসালে অতুলমুনি বুদ্ধ বারাণসী ঋষিপতন মৃগদাবনে এ আষাঢ়ী পূর্ণিমা দিবস সূর্যাস্ত এবং পূর্ণিমাচন্দ্র উদয়ের লগ্নে পঞ্চবর্গীয়দেরকে “বুদ্ধত্ব জ্ঞান লাভ” সম্পর্কে প্রকাশ করেছিলেন। [বিনয় মহাবর্গ পঞ্চবগ্গীয কথা, পটিসম্ভিদামগ্গ ধম্মচক্কপবত্তন বার সুত্ত, মহাবগ্গ সংযুক্ত ধম্মচক্কপবত্তন সুত্ত]

ধম্মচক্ক বচনার্থ- ধর্ম নামক চক্রকে 'পবত্তন' প্রবর্তন করেছিলেন বলেই ধম্মচক্কপবত্তন (ধর্মচক্র প্রবর্তন)।

ধর্মচক্র প্রবর্তন দেশনা চার আর্য্য সত্যেকে ভিত্তি করে দেশিত হয়েছে এটি সমস্ত পিটকত্রয়ের আরস দেশনা।

এ ধর্মচক্র প্রবর্তন দেশনাকে বিশ্লেষণ করলে দুই অন্ত ত্যাগ করে মধ্যমপ্রতিপদ (মধ্যমপন্থা)কে আচরণ করার বর্ণনা রয়েছে।

এটি চার আর্য্য সত্যজ্ঞান সম্পর্কিত দেশনা। এ দেশনার থেকে বুদ্ধের প্রকৃষ্ট ধর্মকে জানার সম্ভব।

এরূপ সম্যক প্রকৃষ্ট সারসংযুক্ত ধর্মকে গুরুত্ব রেখে বৌদ্ধরা এ ধর্মচক্র প্রবর্তন সুত্রকে গুরুত্ব সহকারে পাঠ পঠন করে থাকেন।

এ সুত্রটিকে বৌদ্ধদের গ্রামে গঞ্জে নগরে পাঠ পঠন প্রচার প্রসারের উদ্যোগ নিতে পারলে সবার উপকার হয়।


আষাঢ়ী পূর্ণিমার গুরুত্ব ও তাৎপর্য-

এ আষাঢ়ী পূর্ণিমা দিবসে-
১। বোধিসত্ত্ব প্রতিসন্ধি গ্রহণ।
২। মহা অভিনিষ্ক্রমণ।
৩। ধর্মচক্র প্রবর্তন।
৪। শ্রাবস্তীতে যমক ঋদ্ধিপ্রতিহার্য।
৫। বুদ্ধত্বজ্ঞান লাভ প্রকাশ।
৬। ধর্মরত্ন উৎপন্ন।
৭। সংঘরত্ন উৎপন্ন।
৮। পঞ্চবর্গীয় পৃথকজন থেকে আর্য্যের উপনীত।
৯। এহি ভিক্খু প্রতিলাভ।

তাই বৌদ্ধ সাধু সজ্জনেরা এ "আষাঢ়ী পূর্ণিমা"কে বিশেষ গুরুত্ব রেখে বিহারে গমন করে ফুল, ফল, প্রদীপ, পিণ্ড সহ বর্ষাবাসিক চীবর দান এবং ধর্মচক্র প্রবর্তন সুত্রপাঠ পঠনের মাধ্যমে পু্ণ্যার্জন করে থাকেন।
সবার জ্ঞান ভাণ্ডার পূর্ণ হোক।

লেখক-

স্বধর্ম দেশক, বিদর্শন আচার্য
ভদন্ত পঞ্ঞাদীপ থের
বেতবুনিয়া কেন্দ্রিয় বিহার, কাউখালী
রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা।


Comments

Popular posts from this blog

জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ কি জেনে রাখুন।

মহামঙ্গল সূত্র পালি থেকে বাংলা-২০২১।

নাগরিক পরিচিতি ফরম কেন প্রয়োজন।