প্রতিত্যসমুৎপাদ ধর্মে কি বলা হয়েছে?

প্রতিত্যসমুৎপাদ ধর্মদেশনা করেছেন ভদন্ত পঞ্ঞাদীপ থের মহোদয়।

date-25may2021.

প্রতিত্যসমুৎপাদ ধর্মদেশনা। বৌদ্ধধর্মীয় বিষয়।

(১) অত্থগম্ভীর- কারণ গুরুগম্ভীর।
(২) ধর্ম্মগম্ভীর- ফল গুরুগম্ভীর।
(৩) দেশনাগম্ভীর- দেশন গুরুগম্ভীর।
(৪) পটিবেদ গম্ভীর- জ্ঞাত গুরুগম্ভীর।

"ইমস্মিং সতি ইদং হোতি" - ইহা হলে উহা হয় অর্থাৎ এই কারনেই এই ফল হয়।
"ইমস্মিং অসতি ইদং ন হোতি" -ইহা না হলে উহা হয় না অর্থাৎ এই কারন না থাকলে এই ফল হয় না।

১। অবিদ্যা- (অজ্ঞ) মোহই অবিদ্যা। দুঃখ, সমুদয়, নিরোধ ও মার্গসত্য এ চারসত্যকে না জানাটাই অবিদ্যা। পূর্বান্ত, অপরান্ত অবিচ্ছিন্ন ভবচক্র ০৮ স্থানকে না জানা মোহই অবিদ্যা। ছানিগ্রস্ত চোখ কোনকিছু দেখতে না পাওয়ার মত অবিদ্যা। অবিদ্যা ঢেকে থাকার কারণে ত্রি-ভবের নাম-রূপ দুঃখসত্যকে জানে না।

অবিদ্যা- দুঃখ আর্যসত্যকে না জানা।
অবিদ্যা- দুঃখের কারণ সমুদয় আর্যসত্য তৃষ্ণাকে না জানা।
অবিদ্যা- দুঃখ নিরোধ নির্বান আর্যসত্যকে না জানা।
অবিদ্যা- দুঃখ নিরোধের উপায় আর্যসত্য প্রতিপদকে না জানা।
এ আর্যসত্যকে না জানাটাই মোমূহ অবিদ্যা।

২। সংস্কার-(চেতনা) প্ররোচনা করা, প্রেরণা দেওয়া স্বভাবকে চেতনা বলে। বিপাক নাম-রূপ সমষ্টিকে গঠন করে দেওয়ার লোকিক কুশল/অকুশল চেতনাকে সংস্কার বলে। পুণ্যাভিসংস্কার চেতনা- দেব, মনুষ্য স্কন্ধ তৈরি করে। অপুণ্যাভিসংস্কার চেতনা- অপায় স্কন্ধ তৈরি করে। অনেঞ্জাভিসংস্কার চেতনা- অরূপ স্কন্ধ তৈরি করে।

৩। বিজ্ঞাণ- বিজ্ঞাণ-প্রতিসন্ধি বিজ্ঞাণ। জানার স্বভাবকে বিজ্ঞাণ বলে। প্রতিসন্ধি চিত্ত, লোকিক বিপাক চিত্তকে বিজ্ঞাণ বলে। সন্ধহন বিজ্ঞাণ ইহকাল পরকালের সাথে সংযোগের ধর্ম। মাতৃগর্ভ ভেতরে প্রতিসন্ধি বিজ্ঞাণ। জীবিত থাকা কালীন ৬টি দ্বারে উৎপন্নটা প্রবর্তন বিজ্ঞাণ। ইন্দ্রিয় সক্রিয় না হওয়ার পর্যন্ত ভবঙ্গচিত্ত হয়ে থাকে। কাম/রূপ/ অরূপ প্রতিসন্ধি চিত্ত মোট ১৯টি। অহেতুক অকুশল/কুশল উপেক্ষা সন্তীরণ ০২টি, মহাকুশল বিপাক বিপাক চিত্ত ৮টি, রূপ/অরূপ বিপাক ০৯টি।

৪। নাম-রূপ- প্রতিসন্ধি গ্রহণ ক্ষণে বিজ্ঞাণ সহজাত নাম ৩টি (বেদনা-সংজ্ঞা-সংস্কার) বা চৈতসিক-৫২টি এবং কর্মজ রূপকলাপ। প্রতিসন্ধি বিজ্ঞাণের সাথে উক্ত নাম-রূপ সমষ্টি উৎপন্ন হয় বা চিত্ত, চৈতসিক, রূপ সমষ্টিই নাম-রূপ উৎপন্ন হয়।

৫। ষড়ায়তন-৬টি উৎপত্তি স্থান।
সেই ৬টি স্থান হল চোখ-কান-নাক-জিহ্বা-কায় ও চিত্ত।

ষড় + আয়তন= ষ-৬টি, আয়তন বা উৎপত্তি স্থান। সংসার দীর্ঘকারী ধর্ম ৬টি আয়তন। স্কন্ধ ভেতরে উৎপন্ন স্থান ৬টিকে অাধ্যাত্ম (অভ্যন্তর) আয়তন বলে। ক্লেশ উৎপন্নের বর্ণ-শব্দ-গন্ধ-রস-স্পর্শ ও ভাবচিত্ত এ ৬টি দ্বার ষড়ায়তন।

৬। স্পর্শ- ছুঁত, ছূঁয়া, ধরা, স্পর্শ বলে। চক্ষু+বর্ণ= সংস্পর্শ। কর্ণ+শব্দ= সংস্পর্শ। নাসিকা+গন্ধ =সংস্পর্শ। জিহ্বা+রস= সংস্পর্শ। কায়+স্পর্শ= সংস্পর্শ মন+ ভাব (ধর্মালম্বন)= সংস্পর্শ। (ধর্মালম্বন = সুক্ষ্ম ১৬, চৈতসিক-৫২,নির্বান )

৭। বেদনা- অনুভূতিকে বেদনা বলে। স্পর্শের কারণে বেদনা উৎপন্ন হয়। উপমা- গাছের উপরে উঠার মানুষকে দেখে নিচে থেকে দেখতে থাকা মানুষ ভয়ে দেহ কাঁপানোর মত চোখের স্পর্শ ইত্যাদি। সুখ, দুঃখ ও উপেক্ষা বেদনা। সৌমনস্য (বেশ কিছুক্ষণ সুখ), দৌর্মনস্য (বেশ দীর্ঘক্ষণ দুঃখ)।

৮। তণ্হা- তৃষ্ণা। আস্রব-কামনা-চাওয়া-ভাল লাগা-পছন্দ হওয়াকে তৃষ্ণা বলে।
রুপের তৃষ্ণা, শব্দের তৃষ্ণা, গন্ধের তৃষ্ণা, রসের তৃষ্ণা, স্পর্শ তৃষ্ণা ও পুরনো চক্ষু-শব্দ-স্পর্শাদি ধর্মালম্বনে পুনরায় ভেবে উঠার ধর্মতৃষ্ণা।
পুনশ্চ তহ্না-(১) কামতৃষ্ণা- পঞ্চকাম লোভ, কামরাগ লোভ। (২) ভবতৃষ্ণা- উৎপন্ন হওয়ার ভবের লোভ এটি শাশ্বতদৃষ্টিগত তৃষ্ণা । (৩) বিভবতৃষ্ণা- জন্ম ছিন্নতার তৃষ্ণা, উচ্ছেদদৃষ্টিগত তৃষ্ণা।

৯। উপাদান- অল্প কামনাকে তৃষ্ণা বলে মাত্রাতিরিক্ত তৃষ্ণাকে উপাদান (দৃঢ়াসক্তি) বলে।
উপাদান ৪-প্রকারঃ
(১) কামুপাদান-পঞ্চ কামের দৃঢ়াসক্তি।
(২) দৃষ্টুপাদান- দৃষ্টি বিপ্রলাশ, সংজ্ঞা বিপ্রলাশ, চিত্ত বিপ্রলাশ এর দৃঢ়াসক্তি।
(৩) শীলব্রতুপাদান- সত্যকে মিথ্যা, মিথ্যাকে সত্য মনে করে ভ্রান্ত আচরণের দৃঢ়াসক্তি।
(৪) অত্তবাদুপাদান- নিজের মতবাদ ঠিক, নিজের ধর্ম ঠিক মনে করার আত্মা স্বীকারের দৃঢ়াসক্তি।

১০। ভব- কর্মভব, উৎপত্তিভব ২টি রয়েছে। কুশল/অকুশল কর্মকে কর্মভব বলে। কর্মের কারণে উৎপন্ন লোকিক বিপাক ৩২টি ও কর্মজরূপ গুলোকে উৎপত্তিভব বলে। সংক্ষেপ- কর্মভব হল চেতনা আর উৎপত্তি ভব হল পঞ্চস্কন্ধ।

কর্ম ভব- (১) কায়কর্ম- কায়দ্বারে সম্পাদন কর্ম (২) বাক্যকর্ম- বাক্য দ্বারে সম্পাদন কর্ম (৩) মনকর্ম- মনদ্বারে সম্পাদন কর্ম। ৪-উপাদানের কারণে কর্মভব, উৎপত্তিভব উৎপন্ন হয়। কি উৎপন্ন হয়? পুণ্য, পাপ, আনেঞ্জা অভিসংস্কারের কারণে উৎপত্তি ভবের কাম-রূপ-অরূপ-সংজ্ঞী-অসংজ্ঞী-নৈবসংজ্ঞী ন সংজ্ঞী, একস্কন্ধ, চার স্কন্ধ, পঞ্চস্কন্ধ উৎপন্ন হয়।

১১। জাতি- জন্মের আরম্ভকে জাতি বলে। এই সেই ভবের জন্ম, প্রতিসন্ধি গ্রহণকে জাতি বলে। জাতি- কর্মভবের কারণে জাতি বা জন্ম উৎপন্ন হয়। উক্ত বিজ্ঞাণ উৎপন্নের মত ১৯টি প্রতিসন্ধি বিজ্ঞাণ, ২০টি কর্মজরূপ জন্ম হয়।

১২। জরা-মরণ- বয়োবৃদ্ধ, জরাজীর্ণ, পরিপক্ক জীবন দুঃখ।
মরণ- চার ধাতুরূপ নিষ্ক্রয়তা, দেহঘর সম্পূর্ণ ভেঙে পরা, নিষ্প্রাণতাই মরণ। সত্বগণ এই সেই ভবে তির্যক-প্রেত-অসূর-নিরয়-মনুষ্য-দেব-ব্রহ্মা পঞ্চস্কন্ধ লাভ হলে বয়োবৃদ্ধ, জরাজীর্ণ, মরণ হতে হবেই।

পুনশ্চ জরা-মরণঃ
জরা লক্ষণ ৪-প্রকার (১) জীর্ণ জরা- পরিপক্ক (২) খণ্ডিজরা- দাঁত ভেঙে পরা (৩) পালিত্তজরা- চুল পাকা (৪) বলিত্তজরা- চর্ম ভাঁজ পরা।
মরণ ৩-প্রকারঃ
(১) খন্ধানং ভেদো- পঞ্চস্কন্ধ ভেঙে যাওয়া (২) কলেবরস্স নিক্খেপো- মরদেহকে নিক্ষেপ করা (৩) জীবিতিন্দ্রিযস্স উপচ্ছেদো- জীবিতিন্দ্রিয় ছিন্ন হওয়া।

সত্বগণের অবিচ্ছিন্ন ভবচক্র বিচরণ প্রতীত্যসমুৎপাদ কারণ + কারণ = কার্যকারণ অঙ্গ ১২টি।
১। অবিদ্যা- অজ্ঞ, মোমূহ স্বভাব।
২। সংস্কার (চেতনা)- প্ররোচনার স্বভাব।
৩। বিজ্ঞাণ- জানার স্বভাব।
৪। নাম-রূপ= নাম-(বেদনা-সংজ্ঞা-সংস্কার) রূপ- কর্মজরূপ।
৫। ষড়ায়তন- ৬টি উৎপত্তির স্থান।
৬। স্পর্শ- আলম্বনের সাথে স্পর্শ।
৭। বেদনা- আলম্বনের রস অনুভব।
৮। তৃষ্ণা- আলম্বনের আসক্তি।
৯। উপাদান- আলম্বনের দৃঢ়াসক্তি (কাম, দৃষ্টি, শীলব্রত পরামর্শ, আত্মোপাদান)
১০। ভব- কর্মভব, উৎপত্তিভব।
১১। জাতি-পুনজন্ম।
১২। জরামরণ- বয়োবৃদ্ধ ও শেষ নিশ্বাস।

ত্রি-কালে- অবিদ্যা, সংস্কার।
বর্তমান কালে- বিজ্ঞাণ, নাম-রূপ, ষড়ায়তন,স্পর্শ, বেদনা।
ঘটমান বর্তমান কালে- তৃষ্ণা, উপাদান, কর্ম।
পরকালে- জন্ম, জরামরণ।

ত্রি-ঘূর্ণিপাক বর্ত
ক্লেশবর্ত-অবিদ্যা,তৃষ্ণা, উপাদান।
কর্মবর্ত- সংস্কার, কর্মভব।
বিপাকবর্ত- বিজ্ঞাণ, নাম-রূপ, ষড়ায়তন,স্পর্শ, বেদনা, জন্ম, জরা-মরণ।

বিংশ আকার প্রকারঃ
১। অতীত আকার ৫টি- অবিদ্যা, সংস্কার, তৃষ্ণা, উপাদান, ভব।
২। বর্তমান আকার ৫টি- অবিদ্যা, সংস্কার, তৃষ্ণা, উপাদান,ভব।
৩। ঘটমান আকার ৫টি- বিজ্ঞাণ, নাম-রূপ, ষড়ায়তন,স্পর্শ, বেদনা।
৪। পরকাল আকার ৫টি- বিজ্ঞাণ, নাম-রূপ, ষড়ায়তন,স্পর্শ, বেদনা।

বুদ্ধের সদ্ধর্ম শাসনে প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি অন্য কাজগুলোকে গুরুত্ব না দিয়ে গুরুগম্ভীর মহোপকার হিত সাধন প্রতিত্যসমুৎপাদ ধর্মজ্ঞানই নিরাপদ নির্ভর করার স্মৃতিমান হয়।

বুদ্ধের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনঃ


বুদ্ধ উৎপন্ন না হলে বহু মানুষ এটি পাপকর্ম, এটি পুণ্যকর্ম, এই ভব-সেই ভব, সুগতি কিংবা দুর্গতি জানতে না পেরে অপরাধ দোষযুক্ত পাপকর্ম করে।

বুদ্ধ উৎপন্ন হলে সদ্ধর্ম দেশনার ফলে এটি পাপকর্ম, এটি পুণ্যকর্ম, এই ভব-সেই ভব, সুগতি কিংবা দুর্গতি জানতে পেরে বহু মানুষ পুণ্যকর্ম সম্পাদন করার সুযোগ হয়।

সেই মহা উপকারী বুদ্ধের অনন্তগুণকে শিরে স্থাপন করে কৃতজ্ঞতা জ্ঞানযুক্ত চিত্তে শাসন সদ্ধর্ম চিরস্থিতি তথা সকল প্রাণীর হিত সুখ মঙ্গলের জন্যে ধর্মসেবা করছি।

পূণ্যদান ও উৎসর্গঃ

আজ আমরা এখনি নানা প্রকার উত্তম চেতনার দ্বারা ধর্মদেশনা, ধর্মশ্রবন করলাম এ চেতনা আমাদের অন্তিমে সর্বদুঃখ মুক্ত নির্বানকে প্রত্যক্ষ করার হেতু জ্ঞান প্রজ্ঞা উৎপন্ন হোক।

অদ্যকার আমার যাকিছু পুণ্য সঞ্চয় হলো সঞ্চিত সমস্ত পুণ্যরাশিকে অনন্ত গুণের গুণী মাতাপিতা, গুরুজন সহ দৃষ্ট-অদৃষ্ট, সুখি-দুঃখি, সকল সত্বগণের উদ্দেশ্য সমান ভাগে দান করছি প্রদত্ত পূণ্যরাশি লাভ করে জগতে সকল প্রাণী সুখি হোক।

#সাধু-সাধু-সাধু।

লেখক-
স্বধর্ম দেশক, বিদর্শন আচার্য
ভদন্ত পঞ্ঞাদীপ থের মহোদয়।
রাঙ্গামাটি।
সময়-বিকাল ০৩:০৬ ঘটিকা 
তারিখ-২৫ মে ২০২১ খ্রিঃ।

Comments

Popular posts from this blog

জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ কি জেনে রাখুন।

মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহারে সচেতনতা ও করণীয় কি।

মহামঙ্গল সূত্র পালি থেকে বাংলা-২০২১।