দুঃখ সত্যকে প্রজ্ঞার চোখে জানা।
দুঃখ সত্যকে প্রজ্ঞার চোখে জানা। দুঃখ পাঠশালায় ভর্তি আলোচনায় ভদন্ত পঞ্ঞাদীপ থের মহোদয়।
"চক্খুং ভিক্খবে দুক্খং, সোত দুক্খং, ঘাণং দুক্খং, জিহ্বা দুক্খা, কাযো দুকাখো, মনো দুকাখো"-
ভিক্ষুগণ! চক্ষুদুঃখ, কর্ণদুঃখ, নাসিকাদুঃখ, জিহ্বাদুঃখ, কায়দুঃখ, মনদুঃখ বলে ভাষণ করি।
"রূপা ভিক্খবে দুক্খা, সদ্দা, গন্ধা, রসা, ফোতব্বা, ধম্মা দুক্খা"-
ভিক্ষুগণ! রূপালম্বন দুঃখ, শব্দালম্বন দুঃখ, গন্ধালমন্বন দুঃখ, রসালম্বন দুঃখ, স্পর্শালাম্বন দুঃখ, ধর্মালম্বন দুঃখ বলে ভাষণ করি।
"কিস্মিং লোকে পতিট্ঠিতো"- মানুষ কিসের জগতে প্রতিষ্ঠিত" "দুক্খ লোকে পতিট্ঠিতো"- মানুষ দুঃখ লোকে প্রতিষ্ঠিত বলে ভাষণ করি।
উপরোক্ত ভাষণ মতে- চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, কায় মনের কারণে মানুষ দুঃখের দুঃখী হয় বলে জানা উচিত। পরমার্থতাঃ মানুষ মাত্রে দুঃখী বলে জানা উচিত।
"নত্থি খন্ধসমা দুক্খা, নত্থি সন্তিপরং সুখং"- স্কন্ধ (দেহমন) সম দুঃখ নাই। নির্বানের চেয়ে পরম সুখ নাই বলে ভাষণ করি।
"ইদং খো পন ভিক্খবে দুক্খং অরিযসচ্চং, জাতি'পি দুক্খা, জরা'পি দুক্খা, ব্যাধি'পি দুক্খো, মরণ'ম্পি দুক্খং, অপ্পিযোহি সম্পযোগো দুক্খো, পিযেহি বিপ্পযোগো দুক্খো, যম্পিচ্ছং ন লভতি তম্পি দুক্খং, সংখিত্তেন পঞ্চুপাদান ক্খন্ধা দুক্খা"-
ভিক্ষুগণ! ইহা দুঃখ আর্যসত্য। প্রতিসন্ধি গ্রহণও দুঃখ। বয়োবৃদ্ধ জরাও দুঃখ, পীড়ন ব্যাধিও দুঃখ, পুনঃপুন মরণও দুঃখ, অপ্রিয় সংযোগ দুঃখ, প্রিয়বিয়োগ দুঃখ, যা চাই তা না পাওয়া ইপ্সিত (ইচ্ছিত) বস্তু অলাভ জনিত দুঃখ, সংক্ষেপে আসক্তি জড়িত পঞ্চোপাদান স্কন্ধ সমষ্টি (দেহমন) দুঃখ।
"ইদং দুক্খং অরিযসচ্চ'ন্তিমে ভিক্খবে পুব্বে অননুস্সুতেসু ধম্মেসু চক্খুং উদপাদি, ঞাণং উদপাদি, পঞ্ঞা উদপাদি, বিজ্জা উদপাদি, আলোকো উদপাদি"-
ভিক্ষুগণ ! ইহা দুঃখপুঞ্জ আর্যসত্য বলে বুদ্ধত্ব জ্ঞান লাভের পূর্বে শুনেনি। এ অশ্রুতপূর্ব দুঃখসত্য আমার মনে- সম্যকদৃষ্টি চক্ষু উদয় হয়েছে। জ্ঞাত জ্ঞান উদয় হয়েছে। প্রকারভেদ জানার প্রজ্ঞা উদয় হয়েছে। স্বয়ং প্রত্যক্ষ বিদ্যা উদয় হয়েছে। প্রজ্ঞালোক উদয় হয়েছে।
ও সাধুসজ্জন! উপরোক্ত দুঃখসত্য পুঞ্জকে কুমার সিদ্ধার্থ ০৬ বছর কঠোর দুষ্করাচরণ করার কালেও তিনি জানতে পারেননি। বুদ্ধত্ব জ্ঞান লাভ করার পরেই জ্ঞাত হয়েছে বলে ভাষণ করেছিলেন।
তাই নির্বানকে প্রত্যক্ষ করতে দুঃখসত্যকে বেশি বেশি করে জানতে চেষ্টা করা। যতবেশি দুঃখসত্যকে জানতে পারবে ততবেশি সত্যকে উপলব্ধি করতে পারবে। একটি দুঃখসত্য জ্ঞাত হলে একটি তৃষ্ণা ক্ষয় হয়। এমন চেষ্টা করলে নির্বান পরম সুখ নিরোধ সত্যকে দেখা মিলবে।
"দুক্খং দুক্খসচ্চন্তি আমন্তা"- দুঃখকে দুঃখসত্য বলা হয় কি? "দুক্খসচ্চং দুক্খন্তি"- হ্যাঁ, দুঃখকে দুঃখসত্য বলা হয়।
পঞ্চস্কন্ধ দুঃখকে দুঃখ সত্য বলে প্রজ্ঞা চোখে জানার গম্ভীরভাবে উপলব্ধি করা, বুদ্ধের দুঃখ পাঠশালায় ভর্তি হওয়া।
পরমার্থ স্বভাবধর্মকে জানার উপায়ঃ
পরমার্থ স্বভাবধর্মকে জানার চারটি উপায় রয়েছে। সেগুলো হল লক্ষণ, রস, প্রত্যুপ্রস্থান, পদস্থান।
লক্খণা (লক্ষণ)
সংস্কারের স্বভাবধর্মকে লক্ষণ বলে। পরমার্থ ধর্মের দু'টি লক্ষণ আছে, যথাক্রমে-
১। সামঞ্ঞ লক্খণা- সামান্য বা সাধারণ লক্ষণ
২। সভাব লক্খণা- স্বভাব লক্ষণ।
১। সামান্য লক্ষণটি পরমার্থ ধর্ম সম্পর্কিত লক্ষণ। চিত্ত, চৈতসিক ও রূপ ধর্মগুলো উৎপন্ন, ভঙ্গুরতার কারনে অনিত্য লক্ষণ হয়। পরমার্থ ধর্ম উৎপন্নের হেতুর মান সমতা হলে উৎপন্ন না হোক কেউই বাঁধা দিতে পারে না। এরুপ সম্ভবপর হয় না বলে অনাত্ম লক্ষণ বলে।
ধর্ম কারো মতে চলে না এ জিনিসটা এ জায়গায় স্পষ্ট। মোহ আচ্ছন্নতার শিকার হয়ে সত্ত্বজগত আত্মাকে স্বীকার করেই থাকে। নাম-রূপ অনিত্যের পরাধিনতার স্বভাবকে বহন করে অসন্তুষ্টিতে থাকতে হয় বলে দুঃখের লক্ষণ হয়ে থাকে। তাই এ সামান্য লক্ষণের অনিত্য দুঃখ ও অনাত্মতার লক্ষণ হয়।
এ ছাড়া রূপধর্ম সমূহেরও রুপ্পন (বিরূপ) লক্ষণ আছে। চিত্ত চৈতসিক নামক নামধর্ম সমূহেরও নমন (নমনীয়) লক্ষণ আছে। রুপ্পন এবং নমনকেও লক্ষণ বলে।
২। স্বভাব লক্ষণ অন্যের লক্ষণের সম্পর্কিত না এটি নিজস্ব লক্ষণ হয়ে থাকে। এটি আলম্বন বা বিষয়কে জানার জন্য চিত্তের নিজস্ব লক্ষণ। আলম্বনকে ছূঁয়া স্পর্শ চৈতসিকের নিজস্ব লক্ষণ। কঠিন-কোমল স্বভাব পৃথিবী ধাতুর নিজস্ব লক্ষণ। আবদ্ধ-নিঃসরণ স্বভাব আপ ধাতুর নিজস্ব লক্ষণ। সংকোচন-প্রসারণ স্বভাব বায়ূধাতুর নিজস্ব লক্ষণ। ঠাণ্ডা-গরম স্বভাব তেজ ধাতুর নিজস্ব লক্ষণ। এ লক্ষণগুলোকে স্বভাব লক্ষণ বলে।
রস। রস ২-প্রকারঃ
১। কিচ্চ রস- কৃত্য রস,
২। সম্পত্তি রস- সম্পত্তি রস।
১। কৃত্য রস হল পরমার্থ ধর্মের নিজস্ব স্বভাব। যেমন- মোহ আলম্বন বা বিষয়ের প্রকৃত স্বভাবকে ঢেকে রাখার কৃত্য আছে। দ্বেষ শত্রু ও হৃদয় বস্তুকে জ্বালা করার কৃত্য আছে।
২। সম্পত্তি রস হল উৎপত্তির কারন পরিপূর্ণতাকে বলে। যেমন- মোহ আলম্বন বিষয়কে না জানাটা সম্পত্তি রস। দ্বেষ বা হিংসার কারনে হাত পা কেঁপে উঠা ও চোখেমুখে লাল হয়ে উঠার দোষ চৈতসিকের সম্পত্তি রস।
পচ্চুপট্ঠান (প্রত্যুপ্রস্থান)
কৃত্য রসের উৎপন্নের ফল বা জ্ঞানে বুঝতে পারার স্বভাব কার্যকলাপকে প্রত্যুপস্থান বলে। আলম্বনের স্বভাবকে না জানার কারনে সঠিকভাবে আচরণ করতে না পারার মোহের প্রত্যুপস্থান। দ্বেষ চৈতসিক নিজে এবং অপরের ক্ষতিকারক ধর্ম বলে অনুশীলনকারীর জ্ঞানে স্পষ্ট হয়।
পদট্ঠান (পদস্থান)
কাছাকাছি কারন ধর্মকে পদস্থান বলে। একটি ফলোৎপন্নের পেছনে কেবল একটি কারন নয় পর পর বহু সহযোগী কারন আছে। যেমন- দ্বেষ বা হিংসা উৎপন্নের পেছনে অনিষ্টকর আলম্বন ও সঠিক মনসিকার (মনোনিবেশ) না থাকার এ দু'টি প্রধান কারন থাকে। সেই দু'টি কারন থাকলেও সঠিক মনসিকারের দক্ষ প্রজ্ঞাবান হিংসা করে না। এখানে অমনসিকার হল হিংসার নিকটতম পদস্থান।
এ চার উপায়ের দ্বারা পরমার্থ ধর্মকে বুঝতে পারলে স্বভাব ধর্মকে জানার সুস্পষ্ট হয় এবং মিথ্যা ধারনা দূর হয়ে দৃষ্টি বিশুদ্ধ হয়। এক কথায় বলতে গেলে নাম-রূপের অনিত্য, দুঃখ ও অনাত্ম স্বভাবকে ভাবনার আলম্বনে স্পষ্ট করে জানার জন্য স্মৃতি প্রচেষ্টা অভিরত হয়ে প্রজ্ঞার দ্বারা দর্শন করা। অভিরত মনোনিবেশ হল- "সব্বে সঙ্খারঅনিচ্চ"- সর্ব সংস্কার নিত্য থাকে না উদয়ের পরক্ষণে বিলয় হয়ে যায়। "সব্বে সঙ্খার দুক্খ"- সর্ব সংস্কার দুঃখ (নিত্য না থাকার সংস্কার ধর্ম উদয়ের পর বিলয় হয় বলে দুঃখ)। "সব্বে ধম্মা অনত্ত"- সর্ব ধর্ম অনাত্ম (ধর্ম সমূহ নিজের না) বলে "যোনিসো মনসিকার"- ধর্মত মনোনিবেশ করা।
সবার পরমার্থধর্ম স্বভাব লক্ষণ জ্ঞান লাভের হেতু উৎপন্ন হোক।
লেখক-
স্বধর্ম দেশক, বিদর্শন আচার্য
ভদন্ত পঞ্ঞাদীপ থের
রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা।
Comments
Post a Comment