পালি বর্ণমালা সম্পর্কে ধারণা।
পালি বর্ণমালা সম্পর্কে ধারণা। বৌদ্ধধর্মীয় বিষয়।
পালি বর্ণমালা-
পালি একটি প্রাচীনতম ভাষা। মহাজ্ঞানী ও মহাত্যাগী গৌতম বুদ্ধ তাঁর শিষ্যদের পালি ভাষায় ধর্মদান করেছেন। তাই এই পালি ভাষায় বৌদ্ধধর্মীয় ত্রিপিটক গ্রন্থ রচিত হয়েছে। পালি ভাষায় ত্রিপিটক গ্রন্থ রচিত হওয়ায় এবং গৌতম বুদ্ধের ব্যবহৃত ভাষা হওয়ায় বৌদ্ধধর্মের অনুসারীদের পবিত্র ভাষা।
অনেকের মতে প্রাচীন মগধ রাজ্যের রাজধানী পাটলিপুত্রের নাম থেকে পালি ভাষার নামকরণ করা হয়েছে। মগধ রাজ্যের চলিত ভাষা পালি হওয়ায় এই ভাষাকে মাগধীয় ভাষাও বলা হয়।
যেহেতু বৌদ্ধদের ত্রিপিটক পালি ভাষায় রচিত সেহেতু প্রত্যেক বৌদ্ধধর্মাবলম্বীকে পালি ভাষার উপর জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। কারণ বৌদ্ধধর্ম ও বুদ্ধের শিক্ষা সম্পর্কে প্রকৃত জ্ঞান অর্জনের জন্য অধ্যয়ন ও আচরণ এবং অনুশীলনের প্রয়োজন। আর একটি ভাষা শিক্ষার মাধ্যমে ঐ ভাষাভাষী প্রাচীন মানুষদের ও জনপদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে প্রকৃত ধারণা লাভ করা সম্ভব হয়।
পালি বর্ণমালা পরিচিতিঃ
শব্দের ক্ষুদ্রতম অক্ষরকে বর্ণ বলা হয়। বাংলা ভাষার মত পালি ভাষাও স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ দুইভাগে বিভক্ত। পালি ভাষায় ০৮ (আট) টি স্বরবর্ণ ও ২৩ (তেইশ) টি ব্যঞ্জনবর্ণ রয়েছে।
পালি স্বরবর্ণ সমূহ নিম্নে তুলে ধরা হলঃ
অ আ ই ঈ
উ ঊ এ ও।
স্বরবর্ণ দুই প্রকার-
১। হ্রস্বস্বর ও
২। দীর্ঘস্বর।
আটটি স্বরবর্ণের মধ্যে অ, ই, উ এই তিনটি এক মাত্রায় উচ্চারণ করতে হয়। এজন্য এদেরকে হ্রস্বস্বর বলে।
আ, ঈ, ঊ, এ এবং ও এই পাঁচটি দুই মাত্রায় উচ্চারণ করতে হয়। এই জন্য এদেরকে দীর্ঘস্বর বলা হয়।
পালি বর্ণমালায় বাংলা ভাষার ন্যায় ঋ, ঐ, ঔ অক্ষরগুলি নেই। এই অক্ষরগুলির পরিবর্তে পালি ভাষার অ, ই, উ, এ এই চারটি স্বরবর্ণ দ্বারা ঋ এর কাজ সম্পাদিত হয়।
যেমন-
কৃত = কত,
ঋষি = ইসি,
ঋতু = উতু,
গৃহ = গেহ।
ই, এ এই দুইটি স্বরবর্ণ দ্বারা ঐ এর কাজ সম্পাদিত হয়।
যেমন ঐশ্বর্য্য = ইস্সরিযং,
বৈরী = বেরী।
উ, ও এই দুইটি স্বরবর্ণ দ্বারা ঔ এর কাজ হয়।
যেমন ঔৎসুক্য = উস্সক,
ঔষধ = ওসধ।
পালি ব্যঞ্জনবর্ণ সমূহ নিম্নে তুলে ধরা হলঃ
ক খ গ ঘ ঙ
চ ছ জ ঝ ঞ
ট ঠ ড ঢ ণ
ত থ দ ধ ন
প ফ ব ভ ম
য র ল ব স
হ ল্ ং
স্বরবর্ণের সাহায্য ছাড়া ব্যঞ্জনবর্ণ উচ্চারিত হতে পারে না।
যেমন-
(ক্ +অ) = ক
(ক্ + আ) = কা
(ক্ + ই) = কি
(ক্ + ঈ) = কী
(ক্ + উ) = কু
(ক্ + ঊ) = কূ
(ক্ + এ) = কে
(ক্ + ও) = কো
পালি বর্ণমালায় বাংলা বর্ণমালার মত শ, ষ, য়, ক্ষ, ঃ (বিসর্গ), ´ (রেফ), ঁ (চন্দ্রবিন্দু), ৎ বর্ণ সমূহ নেই।
স এর দ্বারা শ, ষ এর কাজ সম্পাদিত হয়।
য এর দ্বারা য় এর কাজ সম্পাদিত হয়।
ক্ষ, ঃ (বিসর্গ), ´ (রেফ), ঁ (চন্দ্রবিন্দু), ৎ বর্ণসমূহের ব্যবহার পালিতে নেই। কিন্তু বাংলা শব্দে ব্যবহৃত এই জাতীয় বর্ণের পরিবর্তে পালিতে দ্বিত্ব হয়ে থাকে।
যেমন-
দুঃখ = দুক্খ,
ধর্ম = ধম্ম,
যক্ষ = যক্খ।
ড়, ঢ় এই বর্ণ গুলি পালিতে ল্ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
যেমন আষাঢ় = আসাল্হো।
পালি বর্ণমালা উচ্চারণ তুলে ধরা হল ঃ
পালি ব্যাকরণে অ, আ সমান বর্ণ। পালিতে অ, আ দুইটি আকারান্ত উচ্চারিত হয়। সেইরূপ ই, ঈ সমান বর্ণ এবং উ, ঊ সমান বর্ণ।
যেমন- ই কারান্ত ঈর ধ্বনি উচ্চারিত হয় এবং উ কারান্ত ঊর ধ্বনি উচ্চারিত হয়। এ, ও অসমান বর্ণ দীর্ঘস্বর। ক + অ = ক আকারান্ত “কা” ধ্বনি উচ্চারিতব্য হয়।
সেইরূপ ক, খ, গ, ঘ, ঙ।
চ, ছ, জ, ঝ, ঞ।
ট, ঠ, ড, ঢ, ণ।
ত, থ, দ, ধ, ন।
প, ফ, ব, ভ, ম।
য, র, ল, ব, স।
হ, ল্, ং সবই আকারান্ত একমাত্রা উচ্চারিত হবে।
প্রকারভেদ বা পার্থক্য হল হ্রস্বস্বর একমাত্রা এবং দীর্ঘস্বর দুইমাত্রা। সুতরাং আকারান্ত উচ্চারণই বাঞ্ছনীয় হবে।
বাংলা ভাষার আধুনিক গবেষণায় পালি ও প্রাকৃত ভাষার মধ্যদিয়ে বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয়েছে মর্মে জানা যায়। পালি ভাষায় বাংলা ভাষার কয়েকটি বর্ণের উপস্থিতি না থাকলেও পালি ভাষায় বাংলা ভাষার অন্যান্য বর্ণ সমূহ অবিকল পাওয়া যায়। পালি ভাষা বাংলা ভাষার অনুরূপ হওয়ায় ত্রিপিটক পালি বর্ণমালায় রচিত হওয়ায় বাংলা ভাষাভাষী বাংলাদেশী ও ভারতীয়দের পালি ভাষা বুঝতে ততটা বেগ পেতে হয় না।
কিন্তু যারা শ্রীলঙ্কা, চীন, জাপান, ভুটান, বার্মা, থাইল্যান্ড সহ অন্যান্য দেশের ভিন্ন ভিন্ন ভাষার নাগরিক এবং প্রকৃত বৌদ্ধধর্ম চর্চা করেন, আচরণ করেন, অনুশীলন করেন তারা এই পালি ভাষার শিক্ষা নিয়ে থাকেন এবং পালি ভাষার মত বাংলা ভাষাও চর্চা করেন মর্মে জানা যায়।
যদিও পালি ভাষায় রচিত ত্রিপিটক এইসব বৌদ্ধ প্রধান দেশের নিজ নিজ মাতৃভাষায় বা প্রচলিত ভাষায় রচনা করা হয়েছে। তথাপিও যারা প্রকৃতপক্ষে গৌতম বুদ্ধ সম্পর্কে ও সেসময়ের সভ্যতা, ইতিহাস এবং বৌদ্ধধর্মকে জানতে ইচ্ছুক তারা ত্রিপিটক লিখার মূল পালি ভাষা শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে বলেও জনশ্রুতি রয়েছে।
পালি ভাষায় ত্রিপিটক রচনা হওয়ায় এবং পালি ভাষা বাংলা ভাষার প্রায় অনুরূপ হওয়ায় বৌদ্ধপ্রধান দেশে পালি ভাষার কারনে বাংলা ভাষার চর্চা হওয়াটা আমাদের জন্য গৌরবের বিষয়। তাই একজন বৌদ্ধধর্মাবলম্বী হয়ে শুদ্ধভাবে পালি ভাষা উচ্চারণের মাধ্যমে বুদ্ধের নৈতিক শিক্ষা তথা ত্রিপিটক সম্পর্কে জানা, পড়া এবং বুঝার সুবিধার্থে এই কন্টেনটি শেয়ার করা হল।
#কন্টেন্টটি ভাল লাগলে অন্যদের সাথে শেয়ার করুন।
ধন্যবাদ।
Comments
Post a Comment