বড়ুয়া সমাজে বিয়ের অনুষ্ঠানে প্রাণী হত্যা আর কত দিন চলবে।
বড়ুয়া বৌদ্ধ সমাজে বিয়ের আয়োজনে সামাজিকতার নামে প্রাণী হত্যা আর কতদিন চলবে ? বৌদ্ধধর্মীয় বিষয়।
বৌদ্ধ ধর্মে বলা আছে “প্রাণী হত্যা মহাপাপ”। তাই পঞ্চশীলের প্রথম শীল “প্রাণী হত্যা থেকে বিরত থাকব, এই শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি” বলে পঞ্চশীলের প্রথম শীল এবং পর্যায়ক্রমে অন্যান্য শীলগুলি গ্রহণ করা হয়।
আর যাই হোক বৌদ্ধ বিহারে বা যেকোন সংঘদান বা বৌদ্ধদের ধর্মীয় সভা শুরু করার পর পর আমরা পঞ্চশীল গ্রহণ করে থাকি। বড়ুয়া বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা সারা বছর অনেক কষ্ট করে পঞ্চশীল মানলেও বিয়ে বা অনেক সংঘদানের অথিতিদের জন্য খাবার আয়োজনের ক্ষেত্রে চাইলেও পঞ্চশীলের প্রথম শীল আর মানা সম্ভব হয় না।
এই ধরণের খাবার আয়োজনের বিষয় নিয়ে আয়োজকের সাথে কথা বললে প্রায় সময় উত্তরে বলেন, “ফ্রিজের মাংস দিয়ে খাবারের আয়োজন করেছি। আবার অনেকে বলে আগে থেকে এরকম হয়ে আসছে তাই আমার বেলায়ও করতে হচ্ছে। দশ জনের যেই গতি আমারও সেই গতি হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি।”
আমার প্রশ্ন হল,
- এত মুরগী আর খাসী বা ছাগল অনুষ্ঠানের আগের দিন ফ্রিজিং হলো কিভাবে ?
- ফ্রিজে কি মরার পর ঢুকানো না জবাই করে ঢুকানো হল ?
- এত মুরগী আর খাসী বা ছাগল অনুষ্ঠানের আগের দিন ফ্রিজিং হলো কিভাবে ?
- ফ্রিজে কি মরার পর ঢুকানো না জবাই করে ঢুকানো হল ?
নতুন প্রজন্মের অনেকে হয়তো দেখেনি, আমরা দেখেছি আগেকার দিনে শ্রদ্ধাভাজন বৌদ্ধ ভিক্ষুরা কমিউনিটি সেন্টারে গিয়ে বর-কনেকে বিবাহের মন্ত্র দিতেন। কিন্তু বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বিনয় গঠিত যে কোন সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার কারণে শ্রদ্ধাভাজন বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বর-কনেকে বিয়ের মন্ত্র দিতে এখন আর কমিউনিটি সেন্টারে যান না।এখন বৌদ্ধ ধর্মীয় রীতিতে বর-কনেকে বৌদ্ধ বিহারে গিয়ে শ্রদ্ধেয় ভিক্ষুদের নিকট বিয়ের মন্ত্র গ্রহণ করে আসতে হয়।
যদি এটা বড়ুয়া বৌদ্ধ সমাজ মানতে পারে, তবে কেন বিয়ের আয়োজনের সময় সামাজিকতা রক্ষায় প্রাণী হত্যার মহা যজ্ঞ বন্ধ হবে না ?
বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মাধ্যমে বিহারে বর-কনেকে বিবাহ মন্ত্র দেয়ার পর কমিউনিটি সেন্টারে সমাজের এক বিবাহ মন্ত্রদাতা (উপাসক) দ্বারা আবার বর-কনেকে বিয়ের মন্ত্র দেয়া হয়।
তখন দেখা যায়, বৌদ্ধ ধর্মীয়ভাবে বিবাহ মন্ত্র পাঠের সময় বরের মাথায় টুপি পড়া এবং কণের মাথায় ঘোমটা থাকে।
কিন্তু বৌদ্ধ ভিক্ষুরা প্রতিনিয়ত বৌদ্ধ ধর্মীয় সূত্র বা মন্ত্র পাঠের সময় মাথায় টুপি বা ঘোমটা রাখতে নিষেধ করেন।
যাইহোক বৌদ্ধ ধর্মের আয়ুস্কাল ২৫৬৪ বুদ্ধাব্দ শেষ। কিন্তু আমরা এখনও হিন্দু ধর্মের অনেক রীতিনীতি বাদ দিতে পারি নাই। এসব ছোটখাট কিন্তু অনেক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা আমাদের মধ্যে এখনো রয়ে গেছে। এসব কারো কারো নজরে আসলেও সামাজিকতার ভয়ে চুপচাপ থাকে।
ভিন্ন সম্প্রদায়ের ধর্মীয় নিয়মানুযায়ী পশু বলি দেয়া হয়। ভিন্ন সম্প্রদায়ের ধর্মীয় রীতিতে পশু বলির দিন কিছু কিছু বড়ুয়া বৌদ্ধদের এই প্রাণীদের নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করতে দেখা যায়। প্রাণীর জন্য মানুষের প্রাণে দয়ামায়া থাকবে এটাই স্বাভাবিক বিষয়।
কিন্তু নিজের বেলায় একবারও কেন ভাবেন না কতগুলি মুরগী ও ছাগলের প্রাণের বিনিময়ে বিয়ের অনুষ্ঠানে এই খাবারের আয়োজন করা হয়েছে ?
আমার প্রশ্ন হল :
- কেন আমাদের ১০০% বৌদ্ধ ধমীয় বিবাহ রীতি নেই, যদি থাকে তাহলে বিয়ের দিন এত প্রাণী হত্যা করে খাবারের আয়োজন কেন করা হয় ?
- খাবারের আয়োজনে প্রাণী হত্যা করে তা ফ্রিজের মাংস বলে কেন চালিয়ে দেয়া হয় ?
- এই প্রাণী হত্যার মহাযজ্ঞ থেকে আমরা বেরিয়ে আসব কবে ?
- আমাদের বড়ুয়া বৌদ্ধ সমাজের বিভিন্ন সংগঠন একত্রিত হয়ে এই সমস্যা সমাধানে কবে এগিয়ে আসবে ?
- বৌদ্ধ ধর্মীয় পদস্থ শ্রদ্ধেয় মান্যবর ভিক্ষু সংঘরা বিনয় গঠিত সমস্যার কারণে কমিউনিটি সেন্টারে গিয়ে বর-কনেকে বিয়ের মন্ত্র দেওয়া যদি বন্ধ করতে পারেন, তবে কেন বিয়ে ও অন্যান্য অনুষ্ঠানে প্রাণী হত্যা না করে বৌদ্ধ ধর্মীয় রীতিতে অনুষ্ঠানের খাবারের আয়োজনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন না ?
- কখন বড়ুয়া বৌদ্ধদের সামাজিক অনুষ্ঠানে প্রাণী হত্যা বিহীন খাবারের আয়োজন চালু করা হবে ?
প্রাচীনকাল থেকে বিয়ের সময় কন্যা পক্ষকে সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য সম্পূর্ণ খরচ বহন করার রীতি চলমান রয়েছে। এই নিয়ম বাদ দিয়ে বৌদ্ধ ধর্মীয় রীতিতে বিয়ে ও অন্যান্য অনুষ্ঠানের আয়োজন স্বল্প ব্যয়ে করা হোক, যাতে বৌদ্ধ ধর্ম সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়।
আমি চাই বিয়ের নামে এতো টাকা খরচ আর প্রাণী হত্যা করে খাবার আয়োজন এবং উপহারের নামে যৌতুক প্রথা বন্ধ হোক। এমন খাবার আইটেম থাকবে যেখানে পঞ্চশীল পরিপূর্ণভাবে রক্ষা পাবে।
বড়ুয়া বৌদ্ধরা বর্ষাবাসের তিন মাস ব্যাপী প্রাণী হত্যা না করে যথটুকু সম্ভব বিশুদ্ধভাবে পঞ্চশীল ও উপসথ শীল পাল করে থাকে। কিন্তু ত্রৈমাসিক বর্ষাবাস শেষে বড়ুয়াদের বিয়ের অনুষ্ঠানে অসংখ্য প্রাণী হত্যা করে সামাজিকতা রক্ষায় অনিচ্ছা স্বত্বেও এক প্রকার বাধ্য হয়ে অতিথিদের ভোজের আয়োজন করতে হয়।
- এর থেকে পরিত্রাণের কি কোন উপায় নেই ?
- নাকি এই ধরণের খাবারের আয়োজনে প্রাণীহত্যায় পাপ হয় না ?
- প্রাণীহত্যা করা ছাড়া কি সামাজিকতা রক্ষা সম্ভব নয় ?
- বিবাহ অনুষ্ঠানে আগত অতিথিরা কি পঞ্চশীল রক্ষা করেন না ?
- বড়ুয়াদের বিয়ের অনুষ্ঠানে আবহমান কাল থেকে সামাজিকতা রক্ষা করতে গিয়ে প্রাণী হত্যা দিয়ে অতিথিদের ভোজের আয়োজন বন্ধ করা কি খুবই দূরহ ?
হয়তোবা আপনি আজ বর বা কনে যাত্রী। পরের বার হয়তো ভবিষ্যতে আপনার মেয়ের বিয়েতে কিংবা বোনের বিয়েতে আপনিও আপনার মত একই বর বা কনে যাত্রীদের জন্য অসংখ্য প্রাণী হত্যা করবেন।
একটু ভাবুনতো সারা জীবনের পঞ্চশীলের প্রথম শীল এক দিনে বিসর্জন দিলেন নয় কি ?
আশার কথা হল, নতুন প্রজন্মের অধিকাংশ বড়ুয়া বৌদ্ধরা বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে, বুদ্ধের প্রকৃত দর্শন ও ত্রিপিটক নিয়ে অধ্যয়ন ও প্রকৃত ধর্মাচরণ করার চেষ্টায় রত আছেন। প্রকৃত ধর্মভীরু বড়ুয়া বৌদ্ধরা প্রাণী হত্যা ও যৌতুক প্রথা বিরোধী।
তাই হয়তো আধুনিক ও সচেতন বড়ুয়া বৌদ্ধদের হাত ধরে বড়ুয়া বৌদ্ধ সমাজে চিরাচরিত প্রাণী হত্যা করে খাবারের আয়োজন বন্ধ হবে। চালু হবে প্রাণী হত্যা ও যৌতুক প্রথা বিহীন নতুন বিবাহ পদ্ধতি।সেই প্রত্যাশা হলো এই লিখার মূল উদ্দেশ্য।
কাউকে হেয় করার জন্য নয় কিংবা অতি ধার্মিকতার পরিচয় দিতে নয়। শুধুমাত্র বৌদ্ধধর্মীয় নিয়মের সাথে, মহাজ্ঞানী বুদ্ধের দর্শন ও নীতির সাথে বড়ুয়া বৌদ্ধদের চলমান সামাজিক অনুষ্ঠানের কিছু নিয়ম, রীতি-নীতির অসংগতি পরিলক্ষিত হওয়ায় সবাই মিলে সঠিক ধর্মাচরণ করতে এই লিখাগুলি তুলে ধরলাম।
এই বিষয়ে সকলের সুচিন্তিত ও দিক নির্দেশনা মূলক মতামত কামনা করছি। আমার এই কন্টেন্টটি আমার অনুরোধে কয়েক বছর পূর্বে ৩/৪টি বৌদ্ধ ধর্মীয় পত্রিকায় প্রচারিত হয়। এটি আমার লিখা কন্টেন্ট তাই পুনরায় আমার একমাত্র ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটে নতুন আঙ্গিকে তুলে ধরা হল।
ধন্যবাদ জ্ঞাপনে-
জগদীশ বড়ুয়া
Comments
Post a Comment