ধর্মানুদর্শন সতিপট্ঠান দেশনা।
ধর্মানুদর্শন সতিপট্ঠান দেশনায় ভদন্ত পঞ্ঞাদীপ থের মহোদয়।
ধর্মানুদর্শন= ধর্ম + অনুদর্শন। ধর্ম কি? পরমার্থের আপন স্বভাবকে ধর্ম বলে। অনুদর্শন কি? স্বভাবধর্মকে স্বভাবধর্মরুপে অবিপরীত জানাকে অনুদর্শন বলে । স্বভাবধর্ম যেভাবে থাকে ঠিক সেভাবে দর্শন করাকে ধর্মানুদর্শন বলে। দর্শন করা মানেই চর্ম চোখের দেখা নয় জ্ঞানের চোখে দর্শন করাকে বুঝায়। স্বভাব ধর্মকে জ্ঞানের চোখে দর্শন করা যায় বলেই সম্যকদৃষ্টি প্রধান ধর্মানুদর্শন বলে।
বুদ্ধের শাসনের মূল সারঃ
লব্ধ পঞ্চস্কন্ধকে সত্ত্ব আত্মরুপে মিথ্যা ধারনা করে, পঞ্চকাম আলম্বনকে সুখ বলে ভুল ধারনা করে এই দুুই অন্তের মধ্যে এক কামান্ত (অনর্থকর গ্রাম্যাচরণ)।
স্কন্ধের স্বভাবধর্ম প্রকৃতির বাস্তব সম্মত পরমার্থ সত্যকে সত্যরুপে না জেনে কাল্পনার তৈরির ভুল ধারনায় জন্মানো আরেক অনর্থকর অন্ত হল আত্ম কৃচ্ছ্র সাধন (দুষ্করাচরণ)।
এই দুই অনর্থকর অন্ত মুক্ত আচরণটা একমাত্র বুদ্ধের শাসন। বুদ্ধের শাসনের মূলসার হলো সম্যকদৃষ্টি মার্গজ্ঞান।
পঞ্চস্কন্ধ উৎপত্তির মূল কারনকে জানতে হলে ধাতুর স্বভাবধর্মকে জানতে হয়।
পঠবীধাতু (মাটি)- শক্ত-নরম মাটির স্বভাব।
আপোধাতু (পানি)- গঠন নিঃসরণ পানির স্বভাব।
বাযোধাতু (বায়ু)- ভারসাম্য-ভারসাম্যহীন বায়ুর স্বভাব।
তেজোধাতু (তাপ)- উষ্ম-শীত তাপের স্বভাব।
চার মহাভূত ধাতুর মূল স্বভাবধর্মগুলোর একটি আরেকটির সাথে নিত্য বিরোধ প্রতিক্রিয়া হয়ে থাকার কারনে দেহের ভেতরে টনটনানি শূলানি পোড়ানি অবসাদ ঠাণ্ডাগরমের অস্থির হয়ে থাকে। কখনো স্থির হয়ে থাকে না। এই রূপকায়ের স্বভাব সবসময় বিরূপ প্রতিক্রিয়াশীল। এই রূপকায় বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে বলে সত্যের সত্য বলে জানতে পারাটা "সম্যকদৃষ্টি জ্ঞান।
অনিত্যদর্শন
স্মৃতি রত থাকলে পুরো দেহে ভেতরে দেখা যাবে সংস্কার ধর্মসমূহ উদয়ব্যয় অনিত্যের সমষ্টিকে।
দুঃখদর্শন
স্মৃতি রত থাকলে সমস্ত দেহের ভেতর দেখা মিলবে ক্ষয়ব্যয় দুঃখের পুড়ে যাওয়া অস্বস্তিকর দুঃখস্কন্ধ সমূহকে।
অনাত্মদর্শন
যা অনিত্য তা দুঃখ, যা দুঃখ কখনোই নিজের মত করে হয় না সেটি অনাত্ম। এই অনাত্ম নামক স্বভাব ধর্মকে অনাত্মার লক্ষণ জ্ঞানের দ্বারা দর্শন করা। নাম-রূপের স্বভাব লক্ষণের কারনের কাম-রূপ-অরূপ ত্রিভবের সংস্কার সমূহ ঘৃণ্যময় ভরসা রাখার মত কিছুই নাই, অনিরাপদ, অস্বস্তিকর কেবল দুঃখসত্যই বিদ্যমান। সুখ খুঁজে না পাওয়ার নাম-রূপ দেহস্কন্ধ সত্যকে যথাবহ জ্ঞানই সুখবহ।
সংস্কারের কারনে উৎপন্ন নাম-রূপ তদঙ্গ ক্ষণজন্মাই হয়। রূপধর্ম তার আপন বিরূপ স্বভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। নামধর্মও তার আপন স্বভাবে অনিত্যতা প্রাপ্ত হয়। কর্ম-চিত্ত-ঋতু-আহার এই চার কারনের উৎপন্ন নাম-রূপ ধর্মসমূহ কখনো নিত্য স্থিতি থাকার স্বভাব হয় না।
স্মৃতি প্রজ্ঞা পরিপক্ক জ্ঞানীরা লব্ধ পঞ্চস্কন্ধের অনিত্যাদি স্বভাব লক্ষণ ছাড়া কোনকিছুই নেই বলে জানে। স্মৃতি রত থাকলে উৎপন্ন ধর্মসমূহ ক্ষয়ব্যয় হয় বলে জানে। নিত্য না থাকাটা অনিত্য, ক্ষয়ের লক্ষণ জানাটা জ্ঞান। অনুশীলন করলে সবল হয়ে উঠে অনিত্যতার জ্ঞান।
বুদ্ধ প্রধানাঙ্গের পরিপূর্ণ তাই তাঁর দেশিত ধর্মোপদেশ শ্রবন করে সন্ধ্যায় কর্মস্থান গ্রহণ করে বিদর্শন করলে সকালে ধর্মজ্ঞান উদয় হয়। সকাল থেকে বিদর্শন করলে বিকালে ধর্মজ্ঞান উদয় হয়। অকালিকো- জ্ঞান লাভের কোন কালাকাল থাকে নেই। এরুপ প্রত্যক্ষ ফল লাভের শ্রদ্ধাসম্পন্ন হওয়া।
প্রাধান্যতা ৫টি
(১) সদ্ধা হোতি- বুদ্ধের নয়গুণের প্রতি শ্রদ্ধা থাকা।
(২) অপ্পাবাধো হোতি- ধর্মানুশীলনের উপযোগী সুস্থতা থাকা।
(৩) অসঠো হোতি- অপরাধ গোপন না করা, দোষ স্বীকার করা, ধর্মসম্মত অপরাধমুক্ত হয়ে বিদর্শন অনুশীলন করা।
(৪) আরদ্ধ বীরিযো হোতি- দুঃখমুক্তির জন্যে আরদ্ধ (অদম্য) বীর্য থাকা।
(৫) পঞ্ঞাবা হোতি- পরমার্থ নাম-রূপ ধর্মের উদয়ব্যয় মূলস্বভাবকে দর্শনের সমক্ষ জ্ঞানপ্রজ্ঞা থাকা।
বিদর্শনের চারটি স্তম্ভ
কায়-বেদনা-চিত্ত ও ধর্ম হল স্তম্ভ। চারটি থেকে যে কোন একটিকে বিদর্শন করলেও ধর্মের আপন স্বভাবকে না জেনে না বুঝে করলে কেউই লোকোত্তর মার্গের পৌঁছতে পারবে না। স্মৃতিপ্রস্থান ভাবনাকারীকে পরমার্থ ধর্মকে বুঝতে হয়। সতিপট্ঠান অন্য কিছু নয় সেটি হলো পঞ্চস্কন্ধ।
ধর্মানুদর্শন হল রূপ-নাম ধর্মগুলোর সাথে সম্পৃক্ততা থাকা। অনুদর্শন মানেই অনুশীলনকারী স্মৃতি-প্রজ্ঞাকে বুঝায়। ধর্মানুদর্শন বলতে নাম-রূপ স্বভাব ধর্মসমূহকে স্মৃতি-প্রজ্ঞার দ্বারা দর্শন করা। সর্বধর্ম অনাত্মটা কেবল পঞ্চস্কন্ধই হয়। অনাত্ম দর্শন করার পরমার্থ নাম-রূপ ধর্মটাই ধর্মানুদর্শন হয়। দুঃখসত্যকে দর্শন করতে ধর্মানুদর্শন করতে হয়।
১। নীবরণপব্ব- চৈতসিক নামগুলোকে দর্শনের নিয়ম পর্ব।
২। খন্ধাপব্ব- রূপ-নামগুলোকে দর্শনের নিয়ম পর্ব।
৩। আযতনপব্ব- রূপকে দর্শনের নিয়ম পর্ব।
৪। বোজ্ঝঙ্গপব্ব- নামকে দর্শনের নিয়ম পর্ব।
৫। সচ্চপব্ব- রূপ-নাম সমূহকে দর্শনের নিয়ম পর্ব।
পঞ্চনীবরণ প্রহান (তুলে ফেলা)
বিতর্ক ধ্যানাঙ্গ- অলসতা জরতাকে প্রহান করে।
বিচার ধ্যানাঙ্গ- বিচিকিচ্ছাকে প্রহান করে।
প্রীতি ধ্যানাঙ্গ- ব্যাপাদকে প্রহান করে।
সুখ ধ্যানাঙ্গ- উদ্ধত্য কৌকৃত্যকে প্রহান করে।
একাগ্রতা ধ্যানাঙ্গ- কামচ্ছন্দকে প্রহান করে।
পঞ্চস্কন্ধই পরমার্থ ধর্ম। বুদ্ধের 'ধম্মানুপস্সনা' দেশনায় "নীবরণ-স্কন্ধ-আয়তন-বোজ্ঝঙ্গ-সত্য"গুলোর পুরোধাই পঞ্চস্কন্ধ।
ধর্মস্কন্ধকে দর্শন করাটাই ধর্মানুদর্শন। চার সতিপট্ঠান থেকে যেটির দিয়ে দেখুন না কেন পঞ্চস্কন্ধকে দুঃখসত্য বলে জানার গুরুত্বতা রয়েছে।
ইদম্মে অমৃতদানং সব্বে সত্তা সুখিতা হোন্তু।
সবার হিত সুখ মঙ্গল হোক।
লেখক-
স্বধর্ম দেশক, বিদর্শন আচার্য
ভদন্ত পঞ্ঞাদীপ থের মহোদয়।
রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা।
Comments
Post a Comment