বুদ্ধের শাসন অন্তর্ধানের মূলকারণ কী কী আলোকপাত।

বুদ্ধের শাসন অন্তর্ধানের মূলকারণ কী প্রাজ্ঞ আলোচনায় ভদন্ত পঞ্ঞাদীপ থের মহোদয়।



বাংলাদেশী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী তথা বিশ্ব বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য ভদন্ত পঞ্ঞাদীপ থের মহোদয় একটি বড় সম্পদ। শ্রদ্ধেয় ভান্তে প্রতিনিয়ত ত্রিপিটকের আলোকে জ্ঞানগর্ব আলোচনা করে থাকেন। যা এই করোনাকালে অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য ও পূণ্য অর্জনের মাধ্যম। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য ভান্তের এই পূঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনার বিষয়গুলি জেনে রাখা অত্যন্ত প্রয়োজন। তাই অত্যন্ত শান্ত মনে ও শ্রদ্ধা চিত্তে দেশনার বিষয়গুলি শেষ পর্যন্ত পড়ার জন্য অনুরোধ করা হল।

বুদ্ধের শাসন অন্তর্ধানের মূলকারণ সমূহঃ

১। অধিগম শাসন অন্তর্ধান।

২। পটিপত্তি শাসন অন্তর্ধান।

৩। পরিযত্তি শাসন অন্তর্ধান।

৪। লিঙ্গ (বেশ) শাসন অন্তর্ধান।

৫। ধাতু অন্তর্ধান।


১। অধিগম শাসন অন্তর্ধানঃ 

চার মার্গ ফল, চার পটিসম্ভিদা, ত্রি-বিদ্যা ও ষড়াভিজ্ঞানকে অধিগম শাসন বলে। অধিগম ধর্মজ্ঞানগুলো একেকটি অন্তর্ধান হয়ে গেল। বুদ্ধ পরিনির্বানের ১০০০ বছর ভেতর এ চার প্রতিসম্ভিদা ছিল। সেই ১০০০ বছর পরে ষড়াভিজ্ঞান হয়। তারপর ত্রিবিদ্যা হয়। সর্বশেষে অরহতই লাভ হয়। এভাবে একেক অধিগম জ্ঞান কমে গিয়ে অনাগামী যুগ, সকৃদাগামী যুগ, স্রোতাপন্ন যুগ স্তরে নেমে যাবে। অবশেষে কোন এক সময় স্রোতাপন্ন অন্তর্ধান হয়ে গেলে এটি অধিগম শাসন অন্তর্ধান ।


২। পটিপত্তি শাসন অন্তর্ধানঃ 

সমথ বিদর্শন ভাবনা এবং চতুপারিসুদ্ধিসীল হল পটিপত্তি শাসন। এ ধর্মগুলোর অন্তর্ধানকে পটিপত্তি শাসন অন্তর্ধান বলে। শাসনের পরবর্তী সময়ে মার্গ-ফল প্রাপ্তির শ্রদ্ধা বীর্য্য দুর্বল হয়ে গেলে কেবল চতুপারিসুদ্ধিসীলকে পূর্ণ করবে। এ আচরণের দীর্ঘকাল পরে সেই শীলকেও রক্ষা না করে শিক্ষাপদে ক্ষুদ্রতর লঘু আপত্তি থেকে ঘোরতর রকমের আপত্তি গ্রস্ত হবে। তখন মাত্র চার পরাজিকাকে রক্ষা করবে। অবশেষে সেই লজ্জী ভিক্ষু কালগত হয়ে গেলে চার পারাজিকা রক্ষাকারী না থাকার ধরুন পটিপত্তি শাসন অন্তর্ধান হয়ে যাবে।


৩। পরিযত্তি শাসন অন্তর্ধানঃ 

বুদ্ধের দেশিত পালি এবং অর্থকথা'কে পরিযত্তি শাসন বলে। সেই পালি অর্থকথা গ্রন্থ শিক্ষা সমূহ অন্তর্ধানকে পরিযত্তি শাসন অন্তর্ধান বলে। যতদিন বুদ্ধের দেশিত পিটক বিদ্যমান থাকবে ততদিন পরিযত্তি শাসন অন্তর্ধান হবে না। তা দীর্ঘকালের পর আচার্যগুরু এবং চতুর্প্রত্যয় দাতাদের ত্রুটির কারনে পরিযত্তি শাসন অন্তর্ধান হতে থাকবে। এতে প্রথমে অভিধর্মপিটক শিক্ষা দুর্বল হয়ে এ পিটকে পট্ঠান থেকে ধম্মসঙ্গণী পর্যন্ত পর পর অন্তর্ধান হয়ে যাবে। এরপর অঙ্গুত্তর নিকায়, সংযুক্ত নিকায়, দীর্ঘ নিকায় অন্তর্ধান হয়ে কেবল সুত্র এবং জাতক ধরে রাখবে। বিনয়কে লজ্জী ভিক্ষু ধারন করে রাখার মত এ সুত্র জাতক খণ্ডকেও লাভ সৎকার দরকারি ভিক্ষুরাই ধরে রাখবে।


সেই দীর্ঘকাল পরে জাকত খণ্ডগুলোকে কণ্ঠস্থ করে রাখতে না পারায় বেশান্তর জাতক থেকে শুরু করে অপণ্ণক জাতক পর্যন্ত অন্তর্ধান হতে থাকবে। এ জাকতগুলো অন্তর্ধানের পর কেবল বিনয় পিটককে ধারণ করবে। বিনয় ধারক ভিক্ষু বিদ্যমান থাকার কারনে পরিযত্তি শাসন বিদ্যমান থাকবে। পরবর্তী সময়ে ভিক্ষুরা শ্রদ্ধা, সমাধি, প্রজ্ঞা, বীর্য্য দুর্বল হতে থাকলে পরিবার পালি থেকে শুরু করে মহাবিভঙ্গ পর্যন্ত অন্তর্ধান হয়ে যাবে। কোন এক সময় শ্রদ্ধাসম্পন্ন রাজা হাজার স্বর্ণমুদ্রাপূর্ণ স্বর্ণময় ঝুড়িকে হস্তীপিঠে তুলে যে বুদ্ধের দেশিত একটি গাথা আবৃত্তি করতে পারবে সে এ মুদ্রাপূর্ণ ঝুড়ি নিয়ে নাও বলে তৃতীয়বার মত ঢোল পিটিয়ে ঘোষণা করলেও অবশেষে কেউই গাথা আবৃত্তি করে শুনিয়ে নেওয়ার লোক না থাকায় স্বর্ণমুদ্রাপূর্ণ ঝুড়িটি রাজপ্রাসাদে নিয়ে গেলে সেদিনেই পরিযত্তি শাসন অন্তর্ধান হয়ে যাবে।


৪। লিঙ্গ (বেশ) শাসন অন্তর্ধানঃ 

ভিক্ষুর বেশকে লিঙ্গ বলে। বিনয় শিক্ষাপদগুলো ভঙ্গ হতে হতে ভিক্ষুদের পাত্র, চীবর ব্যবহারের শ্রদ্ধাবোধ থাকবে না। পাত্র চীবরগুলো বিনয় সম্মত ব্যবহার না করে নিজের মত করে ব্যবহার করবে। এরপর এমন সময় আসবে ভিক্ষুর বেশও থাকবে না সেদিনই লিঙ্গ শাসন অন্তর্ধান হয়ে যাবে।


৫। ধাতু অন্তর্ধানঃ 

ধাতু পরিনির্বানকে ধাতু অন্তর্ধান বলে। এখানে তিন রকম পরিনির্বানের বর্ণনা রয়েছে। উক্ত তিন রকমের বর্ণনায়-

(ক) ক্লেশ পরিনির্বানঃ অপরাজিত বোধিমূলে বোধিজ্ঞান লাভ করার সাথে সাথে সমস্ত ক্লেশোপশমকে ক্লেশ পরিনির্বান বলে।

(খ) স্কন্ধ পরিনির্বানঃ বুদ্ধ পঁয়তাল্লিশ বর্ষাপূর্ণ অশীতি বছর বয়সে কুশিনগর মল্লদের শালবনে "চ্যুতি কর্মজরূপ" নিরোধ নিবৃত্তিকে স্কন্ধ পরিনির্বান বলে।

(গ) ধাতু পরিনির্বানঃ বুদ্ধের শারীরিক ধাতুগুলো আপনাপনি তেজষ্ক্রিয় দাহ হয়ে সর্বশেষ অন্তর্ধানকে ধাতু পরিনির্বান বলে। বুদ্ধের শারীরিক ধাতুগুলো নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার চৈত্যে পূজারী না থাকায় এবং যেখানে পূজারী থাকবে সেখানে গমন করবে। সেই দীর্ঘকালের পর কোন চৈত্যের পূজারী না থাকাতে সেই বুদ্ধত্বজ্ঞান লাভের অপরাজিত বোধিপালঙ্ক স্থানে গমন করবে।

সমস্তধাতু বোধিপালঙ্কে এসে একত্রিত হয়ে ষড়রশ্মি বিচ্যুরিত ধাতু নিমিত্ত বুদ্ধ হবেন। [সুত্র পাথেয্য। সম্পসাদনীয়]

অতপর শরীর ধাতুগুলো থেকে আগুন বের হয়ে ধাতু নিমিত্ত বুদ্ধ দাহক্রিয়া হবে এতে কোন কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। দাহর আগুনের শিখা ব্রহ্মলোক পর্যন্ত উঠবে। এখানে সরিষা বীজ সমও যদি অবশিষ্ট থাকে আগুনের শিখা না থেমে জ্বলে থাকবে। ধাতুনিমিত্ত বুদ্ধ দাহ শেষ হলে তবেই আগুনের শিখা নিভে যাবে।

বোধিমূল স্থানে শরীর ধাতুগুলো একত্রিত হয়ে ঋদ্ধিপ্রদর্শনের পর ধাতু অন্তর্ধান হয়ে যাবে। ধাতু অন্তর্ধান স্থানে উপস্থিত দেব ব্রহ্মাগণ বুদ্ধ মল্লদের কুশিনগর শালবনের স্কন্ধ পরিনির্বানের মত পুষ্প, সুগন্ধাদি দিয়ে তিনবার প্রদক্ষিণের মাধ্যমে পূজা বন্দনা করত অনাগতে উৎপন্ন বুদ্ধগণের সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করে তাদের অবস্থান ব্রহ্মলোকে ফিরে যাবে। এভাবেই ধাতু শাসন অন্তর্ধান হয়ে যাবে।

দুঃখমুক্তির সত্যের সন্ধানী সত্ত্বদের প্রতি করুণা রেখে শ্রদ্ধাকে ভিত্তি রেখে চার অসংখ্য একলক্ষ কল্পকাল ধরে সাধারণ মানুষের দ্বারা পূর্ণ করার অসম্ভব ৩০ পারমী, পঞ্চ পরিত্যাগ, তিস্সো চরিয (লোকত্থ, ঞাত্থ, বুদ্ধত্থ) ত্রিচর্যের প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধের সদ্ধর্ম শাসন চিরতরে অন্তর্ধান হয়ে যাবে।

"চিরং তিট্ঠতু বুদ্ধ সাসনং"- বুদ্ধের শাসন চিরস্থিতি হোক। বুদ্ধের শাসন রক্ষাকারী ধার্মিক সেবক/সেবিকা উৎপন্ন হোক।


লেখক-

স্বধর্ম দেশক, বিদর্শন আচার্য
ভদন্ত পঞ্ঞাদীপ থের
রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা।
তারিখ-১৭ জুলাই ২০২১ খ্রিঃ।

Comments

Popular posts from this blog

জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ কি জেনে রাখুন।

মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহারে সচেতনতা ও করণীয় কি।

মহামঙ্গল সূত্র পালি থেকে বাংলা-২০২১।